৩০ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ৭:২৯

রাজধানীর পয়োনিষ্কাশন পরিকল্পনা শুধু কাগজেকলমে

‘ঢাকার পয়োবর্জ্য পরিস্থিতি বদলাতে ২০১৩ সালে রাজধানীর পয়োনিষ্কাশন মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ওয়াসা। সে অনুসারে ঢাকার চারপাশের নদীদূষণ রোধে পাঁচটি শোধনাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পয়োবর্জ্য শোধনাগার পর্যন্ত পৌঁছানোর নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়নি, ফলে এই প্রকল্পের কার্যকর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। গত শনিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর উদ্যোগে “বাংলাদেশের স্থানিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়নঃ আগামীর চ্যালেঞ্জ ও করণীয়” শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন ইনস্টিটিউট এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

জানা গেছে, ওয়াসার হিসাবে রাজধানী ঢাকার মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে বৃহত্তর উত্তরা, মিরপুর, বারিধারাসহ ঢাকার বড় একটি অংশে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা একেবারেই নেই। ওয়াসার খাতা-কলমে ৩০ শতাংশের কথা বলা হলেও তার মধ্যে বেশিরভাগ লাইন পুরোনো। মেরামত না করায় এসব লাইন পয়ঃনিষ্কাশনে ব্যবহৃত হয় না। তবে ওয়াসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করলেও এ খাতে সেবা বাবদ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়। বছর বছর এ খাতে আয় বাড়লেও সেবার আওতায় আসেনি রাজধানীবাসী। উল্টো পয়ঃবর্জ্য নদী, খাল ও লেকে ফেলার কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

ওয়াসা সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরী এলাকায় ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি পানি সরবরাহের লাইন রয়েছে। তবে পয়ঃনিষ্কাশনের লাইন রয়েছে মাত্র ৯৩০ কিলোমিটার এলাকায়। তাদের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে মহানগরীর কিছু এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন নালা তৈরি হয়। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু নালা তৈরি হলেও শহর যেভাবে প্রসারিত হয়েছে, সেভাবে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে বিভিন্ন বাসাবাড়ির পয়ঃবর্জ্য সরাসরি মিশছে খাল, নালা ও লেকে। দূষিত হচ্ছে পানি ও পরিবেশ। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটির ব্যবস্থাপনায় গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় একটি জরিপ পরিচালিত হয়। এতে উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান, ঢাকা ওয়াসার প্রতিনিধি, আইটিএন বুয়েটের প্রতিনিধি, হাউজিং সোসাইটির প্রতিনিধি এবং ইউনিসেফ প্রতিনিধির সমন্বয়ে স্যানিটেশন কমপ্লায়েন্স কমিটি জরিপ কাজটির তত্ত্বাবধান করে। চারটি এলাকার ৩ হাজার ৮৩০টি বাড়িতে জরিপ করা হয়। এ বাড়িগুলোর মধ্যে ৩ হাজার ২৬৫টি বাড়ির পয়ঃবর্জ্য সরাসরি সারফেস ড্রেন ও লেকে পড়েছে। মাত্র ৪১টি বাড়িতে পয়ঃবর্জ্যের সংযোগ সঠিকভাবে দেওয়া আছে এবং ৫২৪টি বাড়িতে আংশিকভাবে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে।

ওয়াসার কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার ১০টি অঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি অঞ্চলে স্যুয়ারেজ লাইন আছে। বাকি চারটি অঞ্চলে আংশিক স্যুয়ারেজ লাইন রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এসব স্যুয়ারেজ লাইনে উন্নয়ন কাজ না হওয়ায় অনেকটা বিকলের পথে। ওয়াসার বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ নথিতে এসব লাইন বিকল হওয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে। তারা বলছেন, বর্তমানে ওয়াসার চারটি অঞ্চলে স্যুয়ারেজ লাইন নেই। এ চারটি অঞ্চল হলো বৃহত্তর উত্তরা, বৃহত্তর মিরপুর (অঞ্চল ৪ ও ১০) ও বারিধারা ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৮)। আংশিক স্যুয়ারেজ লাইন আছে লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৩), মহাখালী, গুলশান, তেজগাঁও ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৫), জুরাইন-যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৭) ও মতিঝিল-খিলগাঁও ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৬)। তবে এসব এলাকার প্রায় প্রতিটি ভবনের বিপরীতেই স্যুয়ারেজের বিল আদায় করছে ঢাকা ওয়াসা। এমনকি পানির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যুয়ারেজ বিলও বছর বছর বাড়িয়েছে সংস্থাটি।

ঢাকা ওয়াসার মাত্র একটি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট রয়েছে নারায়ণগঞ্জের পাগলায়। রাজধানীর পয়ঃবর্জ্য পাইপলাইন দিয়ে পাগলা শোধনাগারে যায়। তবে কর্মকর্তাদের দাবি, পাগলা পয়ঃশোধনাগারে কেন্দ্রে রাজধানীর মোট পয়ঃবর্জ্যের মাত্র ১০ শতাংশ শোধনের ক্ষমতা রয়েছে। দাশেরকান্দি এলাকায় একটি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ শেষ হয়েছে। তবে আশপাশের এলাকায় পয়ঃবর্জ্যের লাইন কার্যকর না থাকায় এখনই সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ওয়াসা প্রকল্পনির্ভর প্রতিষ্ঠান হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেবা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে তাদের ঢিলেমি রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের নির্মাণ শেষ। কিন্তু যে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পয়ঃবর্জ্য আসবে এবং পরে নিষ্কাশিত হবে সে নেটওয়ার্ক লাইন নেই কিন্তু প্রজেক্ট শেষ। বড় বাজেট, বড় ব্যয়। কিন্তু কতদিনে বর্জ্যের নেটওয়ার্ক তৈরি হবে সে স্ট্যাডি তাদের নেই। তিনি বলেন, তারা স্বল্প ব্যয়ে যেসব আউটপুট নিতে পারবে, সেসব বিষয়ে তারা আগ্রহী নয়। রাজউকের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী যেসব এলাকায় নেটওয়ার্ক নেই, সেখানে অনসাইটে ট্রিটমেন্ট করার কথা। খালেবিলে ছড়ানোর কথা নয়। এসব বিষয়ে তাদের আগ্রহ নেই। প্রকল্পনির্ভর আগ্রহ, কিন্তু আউটপুটের চিন্তা নেই। যে লাইনগুলো আছে তার বেশিরভাগই বিকল হয়ে আছে, সেই লাইনগুলো ঠিক করে কার্যকর বানানো দরকার। আশপাশে যারা আছে তারা ঠিকমতো ওই লাইনে সংযোগ দিচ্ছে কিনা, নাকি খালে, নদীতে সংযোগ দিচ্ছে তা তদারকি করা দরকার।

সূত্র মতে, মহানগরীর শতভাগ এলাকা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় আনার জন্য বিশ্বব্যাংক সহায়তাপুষ্ট ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্ট শীর্ষক প্রকল্প থেকে ঢাকা মহানগরীর স্যুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রণীত এ মাস্টার প্ল্যানে ঢাকা মহানগরী এবং এর আশপাশের এলাকাকে ১১টি স্যানিটেশন ক্যাচমেন্টে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা পূর্ব-দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, ঢাকা-পশ্চিম-মিরপুর স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, রায়েরবাজার স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, ঢাকা দক্ষিণ-পাগলা স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, ডিএনডি স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, ঢাকা উত্তর-উত্তরা স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, রূপগঞ্জ (পূর্বাচল) স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, নারায়ণগঞ্জ স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, সাভার স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট, টঙ্গী স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট এবং কেরানীগঞ্জ স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্ট। এদিকে রায়েরবাজার স্যুয়ারেজ ক্যাচমেন্টের আওতাধীন রায়েরবাজার এলাকায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা চেয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় রায়েরবাজার এলাকায় ৫৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। প্রাথমিক ধাপ হিসেবে জনবসতি সংখ্যা ও খালি জায়গার পরিমাণ বিবেচনায় টেংগর মৌজায় উত্তর সোনাটেংগর ও দক্ষিণ সোনাটেংগর, কাঁটাসুর, চরকামরাঙ্গী ও মিরপুর মৌজায় এসব জমি অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, ঢাকা শহরের ২০ শতাংশ এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে। বাকি আশি শতাংশ এলাকায় নেই। যদিও আমাদের পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে পুরো ঢাকাকে পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু আদৌ তা সম্ভব নয়। পুরো ঢাকাকে সুবিধার আওতায় আনতে আরও সময় দরকার। বড় বাজেট দরকার। সেবা না দিয়েও পয়ঃনিষ্কাশন বাবদ টাকা নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়, আমরা টাকা নিচ্ছি এটা ভুল। যে ২০ শতাংশ সুবিধাভোগী রয়েছেন, তাদের কাছ থেকেই আমরা টাকা নিয়ে থাকি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় সরেজমিন সার্ভে করেছি। সার্ভেতে পেয়েছি প্রায় ৮৫ শতাংশ বাড়িতেই পয়ঃবর্জ্যের লাইন সারফেস ড্রেনে দিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি অনেকে চোরাই পথে সারফেস ড্রেনে পয়ঃবর্জ্যের লাইন দিয়েছে। শহরকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে এসব সংযোগ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হয়েছে। ওয়াসা পানির দ্বিগুণ সুয়ারেজ বিল নিলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে বলেও জানান আতিকুল ইসলাম।

পয়ঃবর্জ্যের কারণে লেকগুলোর পানি দূষিত হয়ে গেছে উল্লেখ করে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, লেকে মাছ চাষ করা যাচ্ছে না। মশা নিধনে ন্যাচারাল সলিউশন সম্ভব হচ্ছে না মাছ চাষ করতে না পারার কারণে। গুলশান সোসাইটির নবনির্বাচিত কমিটি আমার কাছে এসেছে, তারা সময় চেয়েছিল ৩ মাস। আমি তাদের ৬ মাস সময় দিয়েছি। কেউ ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা ড্রেন ও খাল আর দূষিত হতে দেব না।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, সরকারের মাস্টার প্ল্যানে ঢাকা মহানগরীকে ৫টি (পাগলা, দাশেরকান্দি, উত্তরা, রায়েরবাজার ও মিরপুর) ক্যাচমেন্টে বিভক্ত করা হয়েছে। এই পাঁচটি প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে নগরবাসী শতভাগ উন্নত ও টেকসই পয়ঃসেবা নিশ্চিত হবে। এই প্ল্যানের অংশ হিসেবে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা ডিওএইচএস, বসুন্ধারা,বাড্ডা, ভাটারা, বনশ্রী, কুড়িল, সংসদ ভবন এলাকা, শুক্রাবাদ, ফার্মগেট, তেজগাঁও, আফতাবনগর, নিকেতন, সাতারকুল এবং হাতিরঝিল এলাকার সৃষ্ট পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করে বালু নদীতে নিস্কাশিত হওয়ার মাধ্যমে পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধ করা হবে। এছাড়া সায়েদাবাদ পানি শোধানাগার ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর ইনটেক পয়েন্ট শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণ কমানো সম্ভব হবে।
হিসেব মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন তৈরি হওয়া ১৭৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্যের মধ্যে মাত্র ৩৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য শোধন করতে পারে ঢাকা ওয়াসা। বাকি ১৪০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য ঢাকা ও চারপাশের নদী, খাল এবং জলাশয়ে মিশছে। এর ফলে নগরীর পরিবেশ দূষণ এবং বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে।

ওয়াসা জানায়, ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা-কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকা শহরের পানি ব্যবস্থাপনা আমূল পরিবর্তন এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে কতগুলো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরকে একশত ভাগ সুয়ারেজ নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা এবং পয়ঃবর্জ্য ট্রিট করে নদীতে ফেলার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই পাঁচটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হাতে নেওয়া হয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/547492