২৮ জানুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ১১:৫৬

রাজধানীর বিষাক্ত বাতাস

-আশিকুল হামিদ

কথায় কথায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার কথা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের কারো পক্ষেও সম্ভব নয়। এরকম কোনো ব্যবস্থা কখনো কেউ নিয়েছেন বলে জানা যায় না। তা সত্ত্বেও ঘোষণা দেয়ার কাজটি কিন্তু করে যাওয়া হচ্ছে। আর সে কাজটি করে চলেছেন বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে পণ্যমূল্য কমিয়ে আনা সম্পর্কিত ঘোষণা দেয়ার কারণে বিভিন্নজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু আমরা উল্লেখ করবো এমন একজনের নাম, যার কথা সহজে মনে পড়ার কথা নয়। তিনি বন ও পরিবেশ বিষয়কমন্ত্রী মিস্টার সাবের হোসেন চৌধুরী। অমন একজন ‘নিরীহ’ মন্ত্রীর নাম শুনে পাঠকরা অবাক হতে পারেন। অন্যদিকে তার নাম টেনে আনার কারণ কিন্তু মোটেও সাধারণ বা অস্বাভাবিক নয়।

কেন সাবের হোসেন চৌধুরীর নামই উল্লেখ করা হচ্ছে তার কারণ জানতে হলে প্রথমে তার দু’একটি ঘোষণার বক্তব্য উল্লেখ করতে হবে। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই একের পর এক ঘোষণা দিয়ে চলেছেন তিনি। যেমন নিজের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানান দিতে গিয়ে গত ২৪ জানুয়ারি মন্ত্রী বলেছেন, আগামী একশ’দিনের মধ্যে রাজধানী ঢাকার আশেপাশের পাঁচশ’ অবৈধ ইটভাটা ‘গুঁড়িয়ে’ ফেলা হবে। এর ঠিক পরদিন, ২৪ জানুয়ারি একই মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, একশ’দিনের মধ্যে সচিবালয়কে প্লাস্টিকমুক্ত করা হবে। উল্লেখ্য, প্রথমদিন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুয়রে আর দ্বিতীয়দিন তার সামনে ছিলেন ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা। রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হয়েছে, অন্য দেশের রাষ্ট্রদূত তথা প্রতিনিধিদের সামনে ঘোষণা দেয়ায় সে ঘোষণার বাস্তবায়নের ব্যাপারে পরিবেশমন্ত্রীর তথা আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। মন্ত্রীর ঘোষণা কখন কিভাবে বাস্তবায়ন করা হয় কিংবা আদৌ তা হয় কি না তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই ফাঁকে আমরা বরং পরিবেশের ব্যাপারে সরকারের মনোভাব ও কার্যক্রম সম্পর্কে অন্য কিছু তথ্য যাচাই করে দেখে আসতে পারি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত বা আশান্বিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, রাজধানী ঢাকার পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে পড়েছে। সব রিপোর্টেই বাযুদূষণকে এমন অবস্থার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের কোনো রাজনৈতিক দল নয়, কথাটি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক কয়েকটি গবেষণা সংস্থা। এসব সংস্থা বাযুদূষণ ও পরিবেশ সম্পর্কে জানিয়েও চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু এ বিষয়ে যাদের দায়িত্ব তাদের টনক নড়তে দেখা যাচ্ছে না। ফলে ঢাকার পরিবেশের ভয়াবহ অবনতি ঘটছে এবং নগরবাসীদের জীবনও দ্রুত বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ কিছু তথ্য জানা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলাম্বিয়া এবং হেলথ ইফেক্ট ইনস্টিটিউটের বিশ্ব বায়ু পরিস্থিতি শিরোনামে তৈরি করা এক গবেষণা রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ ক্রমাগত শুধু অসুস্থই হয়ে পড়ছে না, মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ২০১১ সাল থেকেই বায়ুদূষণে ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত রোগে বাংলাদেশে মৃত্যু হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন মানুষের। উল্লেখ্য, এ সময়ই হাজার-হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে উন্নয়নের নামে দেশে নানা ধরনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রিপোর্টটি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছে, সারাবিশ্বে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণজনিত রোগে ২০১৯ সালে বিশ্বে মোট সাড়ে ৬৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতে মারা গেছে ১৬ লাখ ৭০ হাজার। পাকিস্তান এবং নেপালে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ এবং ৪২ হাজার। ওই মার্কিন রিপোর্টে আরো কয়েকটি বিশেষ তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করা হয়েছিল। এসবের মধ্যে প্রধান একটি তথ্য হলো, অতিসূক্ষ্ম কণাজণিত বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় দূষণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয় স্থানে। প্রথম দুটি স্থানে ছিল যথাক্রমে পাকিস্তানের লাহোর এবং চীনের সাংহাই। এরপর ছিল চীনের ইয়াশাই, ভারতের দিল্লি এবং নেপালের কাঠমান্ডুর অবস্থান।

বলা দরকার, ঢাকারই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং টেলিভিশনে প্রতিদিন এমন কিছু ছবি ও লাইভ চিত্র দেখা যায় যেগুলোতে রিকশা, গাড়ি ও সিএনজি ধরনের যানবাহনকে কোনোভাবে বোঝা গেলেও ধূলোবালির কারণে মানুষ এবং যানবাহনের ভেতরের কোনো কিছুকেই দেখা বা বোঝা যায় না। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের মার্চ মাসে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান যাচাই বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার-এর এমন একটি সচিত্র রিপোর্ট বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছিল, যা দেখার ও পড়ার পর সচেতন মানুষেরা ভীত না হয়ে পারেননি। বিশ্বের বায়ুর মান সম্পর্কিত ওই রিপোর্টে জানা গেছে, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা রয়েছে ৭৬.৯। অন্যদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান বা স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা থাকা উচিত ১০-এরও কম। উল্লেখ্য, প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা কত তার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের দেশে দেশে বায়ুর মান নির্ধারণ করা হয়। আইকিউএয়ার-এর রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছিল, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। নয়াদিল্লির পরের স্থানটিই ‘অর্জন’ করেছে ঢাকা! ঢাকার পর পর্যায়ক্রমে রয়েছে শাদের রাজধানী এনজামেনাসহ উজবেকিস্তান ও নেপালের রাজধানী তাসখন্দ ও কাঠমান্ডুসহ অন্য কয়েকটি দেশের দূষিত রাজধানীর নগরীর নাম।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বায়ু দূষণের দিক থেকে ঢাকা এবং সাধারণভাবে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কারণ, কোনো শহরের বায়ু দূষণের মাত্রা ৫০ পর্যন্ত হলে তো বটেই, এমনকি ১০ ছাড়িয়ে গেলেও শহরটিকে অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬.৯! উদ্বেগের কারণ হলো, এর আগেও একাধিক উপলক্ষে ঢাকা শীর্ষ অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। যেমন ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। বায়ু দূষণের মাত্রা ৫০ পর্যন্ত হলেই যেখানে কোনো শহরকে অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক হিসেবে গণ্য করা হয় সেখানে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার দূষণের মাত্রা ছিল ১৯৪। এ ধরনের একটি আশংকাজনক রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল, সরকার নিশ্চয়ই পরিবেশ স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়ে উঠবে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ না নেয়ার ফলে রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে এবং এখনও বেড়েই চলেছে। এ বিষয়ে কিছু ভীতিকর তথ্য জানা গেছে ইংল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক রিপোর্টে। প্রতিষ্ঠানটি বাসযোগ্যতার দিক থেকে ১৪০টি দেশকে নিয়ে গত বছর যে রিপোর্ট প্রকাশ করছে সে রিপোর্টে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৭। অর্থাৎ নিচের দিক থেকে ঢাকা পেয়েছিল চার নম্বর অবস্থান!

বলা দরকার, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মাধ্যমে প্রতিদিন বিভিন্ন শহরের বাতাসের মান তৈরি করে বাতাস কতটা স্বাস্থ্যসম্মত এবং দূষিত বাতাসের কারণে ওই শহরের নাগরিকরা কি পরিমাণ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেÑ এসব বিষয়ে জানিয়ে দেয়া হয়। এটা একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং সব দেশই এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। সেদিক থেকে স্বীকার করতেই হবে যে, ঢাকার বাতাসের মান অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, সরকারের পক্ষ থেকে দূষণ প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা তো নেয়া হচ্ছেই না, উল্টো ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং মেট্রোরেল ধরনের নির্মাণ কাজের মাধ্যমে পরিবেশকে আরো বিপদজনক করে তোলা হচ্ছে। ফলে দূষণের সূচকও ক্রমাগত বাড়ছেই। বায়ুদূষণের পরিণতিতে জটিল ও দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখই কেবল ছড়িয়ে পড়ছে না, দেশে মৃত্যুর হারও বেড়ে চলেছে। এ সংক্রান্ত এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। সে কারণে দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখই শুধু বাড়ছে না, মানুষের আয়ুও অনেক কমে যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতির এত বেশি অবনতি ঘটেছে যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেও এ ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করতে হয়েছে। রাজধানী ঢাকার এবং আশপাশের এলাকার বায়ুদূষণ রোধের জন্য এই নির্দেশনা জারি করেছেন হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি দু’জন মাননীয় বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চের নির্দেশনায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করার জন্য পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নয় দফা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এই নয় দফা নির্দেশনার কতটুকু বাস্তবায়ন করা হয়েছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছিলেন হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ। শুনানিতে অংশ নিয়ে আবেদনকারী আইনজীবী জানিয়েছিলেন, নয় দফা নির্দেশনা ঘোষণার পরপর পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে কিছু কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হলেও সামগ্রিকভাবে অবস্থা একই রকম রয়ে গেছে এবং রাজধানী ঢাকা আবারও সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ঘোষিত নয় দফা নির্দেশনায় মাত্রাতিরিক্ত কালো ধোঁয়া ছড়ানো সকল যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মাননীয় বিচারপতিরা। এর পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া গাড়ির টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইক্লিং করাও নিষিদ্ধ করেছিলেন তারা। ঢাকা এবং এর আশপাশে যেসব অবৈধ ইটের ভাটা তখন পর্যন্তও বন্ধ করা হয়নি সেগুলোর ব্যাপারে ১৫ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়ার এবং বেঞ্চের কাছে রিপোর্ট পেশ করার জন্যও তারা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন।

বেঞ্চের নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছিল, ঢাকায় বালি, ময়লা ও বর্জ্য বহনকারী সকল ট্রাককে ঢেকে চলাচল করতে হবে। যেখানে নির্মাণ কাজ চালানো হবে সেখানে বালি, মাটি ও সিমেন্টসহ সকল নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে। সিটি করপোরেশনের ধূলোবালিপ্রবণ প্রতিটি এলাকায় পানি ছেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দোকান ও মার্কেট এলাকায় দিনের ময়লা-আবর্জনা বস্তায় ভরে রেখে রাতের বেলায় ডাস্টবিন বা ময়লা ফেলার জন্য নির্ধারিত স্থানে ফেলে আসতে হবে।

অন্যদিকে হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া নয় দফা নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলেই ঢাকা আবারও সবচেয়ে বেশি দূষিত নগরীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। স্মরণ করা দরকার, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে প্রতিদিন বিভিন্ন শহরের বাতাসের মান তৈরি করে বাতাস কতটা স্বাস্থ্যসম্মত এবং দূষিত বাতাসের কারণে ওই শহরের মানুষেরা কি পরিমাণ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে- এসব বিষয়ে জানিয়ে দেয়া হয়। এটা একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং সব দেশই এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে ও সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।

ইনডেক্সের মান ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত হলে তার অশুভ প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্যের ওপর। তেমন অবস্থায় বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষদের বাড়ির ভেতরে থাকার এবং বাইরে কোনো কার্যক্রম না চালানোর পরামর্শ দেয়া হয়। ইনডেক্সের স্কোর যদি ১০১ ছাড়িয়ে ১৫০ পর্যন্ত হয় তাহলে তাকে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক মনে করা হয়। অন্যদিকে ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার বাতাসের মান ২১০-এ উঠে গিয়েছিল বলেই একে সবচেয়ে দূষিত নগরী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ঢাকা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

ভীতি ও উদ্বেগের অন্য এক প্রধান কারণ হলো, বায়ুদূষণের পরিণতিতে জটিল ও দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখই কেবল ছড়িয়ে পড়ছে না, দেশে মৃত্যুর হারও বেড়ে চলেছে। এ সংক্রান্ত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। সে কারণে দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখ তো বাড়ছেই, মানুষের আয়ুও অনেক কমে যাচ্ছে।
দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, উন্নয়নের নামে লক্ষ-হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান নির্মাণ কাজের পাশাপাশি ইটের ভাটাগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ কালো ধোয়া ঢাকার বাতাসে মিশতে থাকে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যানবাহনের কালো ধোয়া। এ দুটির সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে যুক্ত হয়েছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ছড়িয়ে পড়া ধূলোবালি। ফ্লাইওভার এবং বিশেষ করে মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণ উপলক্ষে বছরের পর বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলতে থাকায় বাতাসে ধূলোবালির পরিমাণও আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। ফলে রাজধানীতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ ফুসফুসের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, চোখের সমস্যা, ডায়াবেটিস এবং নিউমোনিয়ার মতো বিভিন্ন রোগবালাই বেড়ে চলেছে।

সব মিলিয়েই রাজধানী ঢাকার দূষিত বায়ু ও পরিবেশ যে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেকথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই নয় দফা নির্দেশনা জারি করেছিলেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। সরকারের উচিত বায়ুদূষণ প্রতিরোধের জন্য হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া নয় দফা নির্দেশনার আলোকে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া। চলমান সকল নির্মাণ কাজ দ্রুত সমাপ্ত করতে হবে এবং কাজ চলাকালীন সময়ে পানি ছেটানোর মতো এমন কিছু ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক রাখতে হবেÑ যার ফলে বাতাসে ধূলোবালি ছড়িয়ে পড়তে না পারে। দ্বিতীয় একটি পদক্ষেপ হিসেবে রাজধানীর ভেতরে ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে সকল ইটের ভাটা সরিয়ে দিতে হবে। হাইকোর্ট বেঞ্চের নির্দেশনার ভিত্তিতে বায়ুদূষণ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় অন্য সকল ব্যবস্থাও নিতে হবে কাল বিলম্ব না করে। এখন দেখার বিষয়, পরিবেশমন্ত্রীর দেয়া ঘোষণা কতটা কতদিনের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়, নাকি এবারের ঘোষণাগুলোকেও ঝুলিয়ে রাখা হবে? বলা দরকার, জনগণ চায়, রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশ বায়ুদূষণের কবলমুক্ত হোক এবং নিরাপদ হোক মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন।

https://www.dailysangram.info/post/547426