১৩ মে ২০১৭, শনিবার, ৮:৫৯

আসন্ন বর্ষায়ও ভোগান্তির আশঙ্কা

রাজধানীতে জলাবদ্ধতার সমাধান মিলছে না

দুই সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসার প্রতি বছর ব্যয় হচ্ছে শত শত কোটি টাকা

রাজধানীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে এসব আবর্জনা পরিষ্কার, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন করলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না ঢাকাবাসীর।


ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা করতে ঢাকা ওয়াসা বিগত সময়ে ড্রেনেজ বিভাগের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সংস্কার ও উন্নয়নকাজ করেছে। আর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বিগত পাঁচ বছরে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। বর্তমান সময়েও ড্রেনেজ উন্নয়নের ব্যাপক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তার পরও রাজধানীর ২৬টি খাল, তিন হাজার কিলোমিটার ড্রেন এবং জলাশয়গুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

সম্প্রতি আধাঘণ্টার বৃষ্টিতে মহানগরীর মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, রাজারবাগ, মিরপুর, প্রগতি সরণি, বনশ্রী, রামপুরা, কমলাপুর, গোলাপবাগ, শ্যামলী, ধানমণ্ডি, গুলশান-১ ও গুলশান-২, বনানী, আজিমপুর, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, পরিবাগ কারওয়ান বাজার এলাকার সড়কের কোনো কোনো অংশে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। বর্ষার মৌসুম সন্নিকট হলেও এখনও ঢাকা শহরের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। ভরা বর্ষায় এই অবস্থা বিরাজমান থাকলে জলাবদ্ধতা কী ভয়াবহ রূপ নেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়হীনতা, অপরিকল্পিত, অদূরদর্শী কার্যক্রম এবং নগরবাসীর অসচেতনতার কারণে মূলত জলাবদ্ধতার সুফল মিলছে না। সমস্যাগুলোর মধ্যে ‘জনসচেতনতা’কে বড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি বড় সমস্যা হলেও এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নেই। মাঝে মধ্যে কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে সেটিও টেকসই কিছু নয়। তবে বেসরকারি পর্যায়ে টেকসই জনসচেতনতা সৃষ্টির কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দুটি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম’ (সিপ)। এই সংস্থাটি দুর্যোগ সহনশীল ঢাকা কর্মসূচির আওতায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিগত সময়ে ওই দুটি ওয়ার্ডে সিপ জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির আওতায় অনেক মানুষকে জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘টেকনিক’ শিক্ষা দিয়েছে। বর্ষার সময় কোথাও জলাবদ্ধতা হলে ওই এলাকার প্রশিক্ষিত লোকেরা নিজেরাই সড়কে নেমে পানি সরানোর কাজ করেন। আর এই কাজে সিপকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন কাউন্সিলররা। এ ব্যাপারে সিপের দুর্যোগ সহনশীল ঢাকা কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক সাইফুন নাহার যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত কার্যক্রম এবং অসচেতনতা অন্যতম। কেননা, ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন মাধ্যম ড্রেন, খাল, ডোবা ভরে ফেলছে নগরবাসী। আবার জলাবদ্ধতার ভোগান্তিরও শিকার তারা। নগরবাসীকে সচেতন করার পাশাপাশি সমন্বিতভাবে জলাবদ্ধতা নিরসন কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে। নইলে ভোগান্তি বাড়তে থাকবে।

জানা যায়, কুড়িল থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার। এই সড়কের দুই পাশে পানি নিষ্কাশন ড্রেন রয়েছে। প্রতি বছর এই ড্রেন পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু তার পরও বর্ষার মৌসুমে এই ড্রেন দিয়ে যথাযথ নিয়মে পানি নিষ্কাশন হয় না। কারণ ড্রেনের দুই পাশের বসবাসকারী, দোকানদার, পথচারীরা সরাসরি এই ড্রেনেই ফেলছে গৃহস্থালি বর্জ্য, নির্মাণ বর্জ্য, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন আবর্জনা। দীর্ঘদিনের এ সমস্যার সমাধান করতে এবার বছরব্যাপী ড্রেন পরিষ্কারের জন্য ৩১ লাখ টাকা দিয়ে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। ওই প্রিতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে, চলতি মাস পর্যন্ত ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাঁচবার ড্রেনটি পরিষ্কার করেছে। এর পরও আসন্ন বর্ষায় এই সড়কে জলাবদ্ধতা হবে না, সেটার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না ডিএনসিসি।

সরেজমিন দেখা গেছে, আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে রাজধানীর মহাখালী খাল। এ কারণে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ খাল দিয়ে মিরপুর, ক্যান্টনমেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নাখালপাড়া, শাহীনবাগ, আরজত পাড়া, মহাখালী, রসুলবাগসহ আশপাশের এলাকার ময়লাপানি নিষ্কাশন করা হয়। এ খালটি ময়লা আর্বজনা দিয়ে পূর্ণ হওয়ায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সীবাড়িসহ ওই ওয়ার্ডের বেশির সড়কেই সাম্প্রতিক বর্ষায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এ কারণে ওই এলাকার বাসিন্দারা এবারের বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আতঙ্কে ভুগছে। এলাকাবাসী জানায়, বর্ষা মৌসুমে ওই এলাকার আশপাশের নর্দমার ময়লা পানি অধিকাংশ আবাসিক বাসার নিচতলায় ঢুকে পড়ে। এলাকার বেশির ভাগ অংশে জলাবদ্ধতা লেগে থাকে। ঢাকার মিরপুর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত ইব্রাহিমপুর খাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কাগজ কলমে ৬০ ফুট খালের ৩০ ফুটই বেদখল। অসাধু ব্যক্তিরা খাল দখল করে দোকানপাট, পাকা ভবনসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। আর খালের অবশিষ্টাংশ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। এর ফলে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতে মিরপুরের ইব্রাহীমপুরসহ আশপাশের এলাকায় জলজট ও জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। বর্ষার মৌসুমে ওই এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তির অন্ত থাকে না।

এ ছাড়াও রাজধানীর রামচন্দ্রপুর, হাজারীবাগ, বছিলা, কল্যাণপুর, কুতুবখালী, নন্দীপাড়া, বাড্ডা, বোয়ালিয়া খালেরও বেহাল দশা। আবর্জনায় ভরাট এসব খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে খালসংলগ্ন আশপাশের এলাকায় জলজট ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : নগরবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে পানি নিষ্কাশন মাধ্যমগুলো সঠিক ‘মেইনটেনেন্স’ করে সক্রিয় রাখতে হবে। ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকলে সুফল আসবে না। তা ছাড়া শোনা যাচ্ছে ড্রেনেজের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন নিতে চায়, সেটা নিলেও দ্রততম সময়ের মধ্যে নিয়ে নেয়া উচিত। প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় টেকসই ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি খালগুলো দখল ও ভরাটমুক্ত রাখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নয়নের কাজ চলছে। আশাকরি জলজট ও জলাবদ্ধতা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, নতুন ড্রেন তৈরি, সংস্কার ও উন্নয়নকাজ চলছে। আগামী বছরের মধ্যেই জলাবদ্ধতার বেশির ভাগ নিরসন করা সম্ভব হবে।

ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান বলেন, ঢাকা ওয়াসা রুটিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ড্রেন ও খাল সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/13/124098/