২৬ জানুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ৪:১১

ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম

আমনের ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম। কিন্তু কেন তার কোন উত্তর নেই কারো জানা। সরকার বলছে ধান চালের রিজার্ভ সংকট নেই। সরবরাহ রয়েছে স্বাভাবিক। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ বছর আমনের উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ সরবরাহ পুরোদমে থাকলেও এখন মিল, পাইকারি ও খুচরা প্রায় সব পর্যায়ে চালের দাম বাড়ছে। শুধু পাইকারিতেই গত এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৬ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত নতুন মৌসুমের চাল বাজারে আসার আগে দাম বাড়তে দেখা যায়। কিন্তু এবার আমনের চাল সরবরাহের ভরা মৌসুমেও হঠাৎ দাম বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ভোক্তার অভিযোগ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণেই বাড়ছে চালের দাম।

সরকার নির্বাচনের আগে বলেছিল তারা যেকোনভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনবেন। কিন্তু নতুন করে ক্ষমতা বুঝে নিতেই বেড়েছে চালের দাম। কিন্তু কেনো তার কোন উত্তর দিতে পারেনি সরকারের খাদ্যমন্ত্রী। এনিয়ে কথা বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী,কৃষিমন্ত্রী এবং শিল্পমন্ত্রী। কিন্তু কোনভাবেই দাম কমছে না। সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু বাজারে দাম কমার কোন লক্ষণ নেই। উল্টো দাম বেড়েই চলছে।

উল্লেখ্য, দেশে মোট চাল উৎপাদনের ৪০ শতাংশ হয় আমন মৌসুমে। চলতি আমন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। মোট ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে এ বছর ধানের আবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাটা হয়েছে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর বা সাড়ে ৯৭ শতাংশ জমির ধান। এখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন। গড় ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৯৮ টন। উৎপাদন ভালো হওয়ার পরও এবার হঠাৎ করে আমনের ভরা মৌসুমেই মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মিলগেটে ব্যবসায়ীদের চাল কিনতে হচ্ছে কেজিতে ৪-৬ টাকা বেশি দামে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ টন চাল মজুত রয়েছে। এটা সত্য, কয়েক বছর ধরেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতিও। ফলে বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের খাদ্যাভ্যাসে চাপ ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭১ শতাংশ পরিবার খাদ্যপণ্যের দাম বেশি থাকা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন। বিশ্ববাজারে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। এজন্য ব্যবসায়ীরা হয়তো দেশের বাজারেও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার সিন্ডিকেশনের কারণেও দাম বেড়েছে। কিন্তু এ সময়ে দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অভিযোগ উঠছে, মুনাফা বাড়ানোর প্রবণতা থেকে মিল পর্যায়েই কৃষকদের থেকে কম দামে কেনা চালের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে।

আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে ভাত-প্রধান বাঙালি যদি তাদের চাহিদামতো চাল কিনতে না পারে তবে, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে। বিশেষ করে মোটা চালের দামবৃদ্ধি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ মোটা চাল নির্ভর। মনে রাখতে হবে চালের দাম বেড়ে গেলে সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। সুতরাং যে করেই হোক, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

আসলে পণ্যের সরবরাহ বা সংকটের সঙ্গে দাম বাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা হচ্ছে অসৎ ব্যবসায়ীদের হীনমানসিকতা। অতীতেও আমরা লক্ষ্য করেছি, তারা একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের পকেট কেটেছে। অতীতে তারা তেল পেঁয়াজ ডিম চিনির দামও বাড়িয়েছিল। আর চালের দাম তো নানা অজুহাতে কয়েক দফা বাড়ল। এটা তাদের ব্যবসায়িক অসুস্থ সংস্কৃতি। এটা হচ্ছে বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজি। এরা জনগণের স্বার্থের দিকে নজর দেয় না। এরা বাজার সন্ত্রাসী। কীভাবে অসৎ উপায় অবলম্বন করে দ্রুত ধনী হবে এটাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। ফলে তাদের কাছে দেশের অসহায় জনগণ জিম্মি হয়ে পড়ে। নতুন সরকার গঠিত হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর অঙ্গীকার রয়েছে। আমরা আশা করব, নতুন সরকার এ ব্যাপারে দ্র¤œত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মোকাম কুষ্টিয়ার বাজারেও বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। গত এক সপ্তাহে খুচরা বাজারে প্রায় সব রকম চালে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৪ টাকা। এ নিয়ে আমন মৌসুম শেষ না হতেই তিন দফায় চালের দাম বাড়ল।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মোকাম থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আর ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকেরা বলছেন, প্রতিদিনই বাড়ছে ধানের দাম। সে কারণে চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে। মিল গেটে কেজিপ্রতি দুই থেকে আড়াই টাকা বেড়েছে। ধানের দাম বৃদ্ধির ওপরও নজরদারি করার দাবি জানিয়েছেন চালকল মালিকেরা।

বাজার সূত্রে জানা গেছে, নানা অজুহাতে গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছিল ৩ টাকা পর্যন্ত। মাত্র দুই মাস পর কয়েক দিন ধরে খুচরা বাজারে আবারও সব ধরনের চাল কেজিতে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চলতি আমন মৌসুম শেষে এ নিয়ে তিন দফায় কুষ্টিয়ায় চালের দাম বাড়ল।

কুষ্টিয়ার বাজারে দেখা যায়, ৬২ টাকার মিনিকেট চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকায়। কয়েক দিন আগেও ৫৬ টাকায় বিক্রি হওয়া কাজললতা চাল এখন ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মোটা চাল কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৩ টাকা।

কয়েক দিনের মধ্যে দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন চাল বিক্রেতা বলেন, বেশি দামে মোকাম থেকে চাল কিনতে হচ্ছে। কদিন আগে কাজললতা চাল ৫৬ টাকায় বিক্রি করেছেন, সেটি এখন ৬০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। মোকাম থেকে বস্তা প্রতি বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে চাল। সেই সঙ্গে পরিবহন খরচ যোগ করে কেজি প্রতি চালের দাম ৪ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাজার সূত্রে জানা গেছে, ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে অক্টোবরের শেষ দিকে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল। এর এক মাস আগেও সব ধরনের চাল কেজিতে ১ থেকে ২ টাকা বাড়ে।

ভরা মৌসুমেও আলুসহ অন্যান্য শীতের সবজির দাম এখনো চড়া। অন্যান্য নিত্যপণ্যেও স্বস্তি নেই। এর মধ্যে বারবার চালের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। চাল কিনতে আসা কয়েকজন ক্রেতা অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ী ও মিলমালিকেরা বরাবরের মতো আবার সিন্ডিকেট করে চাল মজুত রেখে দাম বাড়াচ্ছে। প্রশাসন চাইলে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর এই প্রবণতা ঠেকিয়ে দিতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

চালের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান বলেন, ডিসেম্বর থেকে ধানের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ধানের দাম প্রতি মণে ১৮০-২০০ টাকা বেড়েছে। মণ প্রতি মিনিকেট যে ধান আগে কিনেছিলেন ১ হাজার ৪২০ টাকা মণ, সেই ধান এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৬৮০ টাকায়। সরকার যখন আমন মৌসুমে চাল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন নতুন ধান ৯৮০ থেকে ১ হাজার টাকা মণ কেনা হয়। সেই ধান এখন ১ হাজার ৮০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে চার প্রকার ধান উঠেছে। মোটা হাইব্রিড, স্বর্ণা, ধানি গোল্ড ও বিনা-৭। নভেম্বরের শেষের দিকে এই ধান উঠলেও ডিসেম্বরে এসে দাম বেড়ে গেছে।

জয়নাল আবেদীন বলেন, ধানের দামের বৃদ্ধির কারণে মোকাম থেকেই চালের দাম কেজিতে দুই থেকে আড়াই টাকা বেড়েছে। ধানের বাজার যে মণপ্রতি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা বাড়ল সেদিকেও সরকারকে নজর দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

https://www.dailysangram.info/post/547140