২৪ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৩:৪১

কম দামে গরুর মাংস বেচে প্রাণ হারানোর ভয়

কম দামে গরুর মাংস ভোক্তার হাতে তুলে দিয়ে বাজারে স্বস্তি ফেরাতে চেয়েছিলেন কিছু ব্যবসায়ী। মাংস সিন্ডিকেটের রক্তচক্ষুর রোষে পড়ে ওই ব্যবসায়ীরাই এখন অস্বস্তিতে। ওই চক্র গরুর মাংসের বাজারে এতটাই ভীতি ছড়িয়েছে, খুনখারাবি করেও বাজার নিজেদের কবজায় রাখতে মরণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কম দামের মাংস বেচতে গিয়ে এরই মধ্যে চক্রের হাতে জীবন দিয়েছেন এক বিক্রেতা। অন্য ব্যবসায়ীদেরও দেওয়া হচ্ছে হত্যার হুমকি। প্রাণ বাঁচাতে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চাচ্ছেন। এমন অস্থির পরিস্থিতিতে আবারও গরুর মাংসের দাম নির্ধারণের দাবি উঠেছে।

পাশাপাশি বাজারে অভিযান জোরদার করা, পশুখাদ্যের দাম কমানো, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ, হাটে খাজনা কমানো, উন্নত জাতের গরু পালনের অনুমতি, সরকারি ব্যবস্থাপনায় সুলভ মূল্যে সারাবছর ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে মাংস বিক্রি, চামড়া ও দুধের দাম বাড়ানো, ঢাকায় খামারি বাজার স্থাপনসহ চাষিদের নীতি সহায়তা দেওয়ার দাবি তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। খামারি ও মাংস ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, মাংসের বাজারে সিন্ডিকেট নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। তবে পশুখাদ্যের সিন্ডিকেট নিয়ে কেউ ভাবে না। সব সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে নীতি সহায়তা দিলে ৫০০ টাকা কেজিতেও গরুর মাংস ভোক্তাকে দেওয়া সম্ভব।

মাস ছয়েক আগে মাংসের বাজারে ক্রেতার হাহাকার চললে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে গত ৩০ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সঙ্গে বৈঠক করে মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকা কমানোর ঘোষণা আসে। পরে ভোক্তা অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপে গত ২২ ডিসেম্বর মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন সম্মিলিত বৈঠক করে ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। এমন সিদ্ধান্তে বাজারে ফিরে আসে স্বস্তি। তবে মাস না যেতেই আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ওই চক্র। কম দামের বিক্রেতাদের একের পর এক হুমকি দিতে থাকে। সিন্ডিকেট শেষ পর্যন্ত এতটাই ভয়ংকর হয়ে ওঠে, এক বিক্রেতার প্রাণও কেড়ে নেয়। ২০ জানুয়ারি রাজশাহীর বাঘার আড়ানী হাটে কম দামে মাংস বিক্রি করায় মামুন হোসেন (৩০) নামে ওই মাংস ব্যবসায়ী খুন হন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মাংস ব্যবসায়ীদের মনে ভয় ধরে। সর্বশেষ কম দামে মাংস বিক্রি করে সুনাম কুড়ানো রাজধানীর শাহজাহানপুরের ব্যবসায়ী মো. খলিল ও মিরপুরের উজ্জ্বলকে দেওয়া হয় প্রাণনাশের হুমকি।

খলিল যখন বেশি দাম মাংস বেচতেন, তখন চার-পাঁচটি গরু বিক্রি করতেই কষ্ট হতো। এখন তিনি দৈনিক জবাই করেন ৩৫-৪০টি গরু। দিনরাত লাইন ধরে মাংস কিনতে থাকেন ক্রেতা। যে বিক্রেতারা ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতেন, খলিলের দেখাদেখি তারাই গত এক মাস ৬০০ টাকা বা তার চেয়ে কমে বিক্রি করে পোষাতে পারছেন। এ পরিস্থিতিতে নানা চাপে খলিল এক সপ্তাহ ধরে প্রতি কেজি মাংসের দাম ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করেছেন। তবে একটি চক্র এতেও সন্তুষ্ট নয়। তারা প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়েই যাচ্ছে। তিনি সমকালকে বলেন, ‘দুটি নম্বর থেকে আমার কাছে ফোন আসে। তারা বলছে, তোর ছেলের জন্য ছয় বুলেট, তোর জন্য ছয়টা রেখেছি। কথা না শুনলে বাবা-ছেলেকে মেরে ফেলব। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমি শাহজাহানপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার নিরাপত্তায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কম দামে মাংস বিক্রি করে আমি কী অপরাধ করলাম? একা বের হতে পারছি না। বাসায় সবাই ভয়ে আছে।’

যশোরে ৭৫০ টাকা মূল্যের গরুর মাংস ৬৫০ টাকায় বিক্রি করায় মাংস ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের প্রচার মাইকের ওপর হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে।

নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগে মাংস বিক্রেতা ও খামারিরা মিলে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করেন প্রতিকেজি ৬৫০ টাকা। নির্বাচনের দিন (৭ জানুয়ারি) পর্যন্ত বাজারে এ দাম কার্যকর ছিল। এখন আবার নির্ধারিত দামে গরুর মাংস বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

সম্প্রতি গরুর মাংসের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীরা সভা করেছেন। এ বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজা বলেন, নির্ধারিত দামে মাংস বিক্রি করতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ী লোকসানের মুখে পড়ছেন। বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে মাংসের দাম নির্ধারিত হবে। তবে ক্রেতাদের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে দাম যতটুকু সম্ভব কমিয়ে রাখা হবে।

এখন অধিকাংশ জায়গায় প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা। কোথাও কোথাও ৬৫০ টাকায় পাওয়া গেলেও তাতে ওইসব ব্যবসায়ীরা আছেন ভয়ে। সামনে আসছে পবিত্র শবেবরাত ও রমজান। সাধারণত এ সময়ে বাজারে মাংসের দাম একটু বাড়তি থাকে। ঠিক এ সময়ে ব্যবসায়ীরা গরুর মাংসের নির্ধারিত দর থেকে সরে এলেন।

কিছু মাংস ব্যবসায়ীর দাবি, খামার পর্যায়ে গরুর দাম বেড়েছে– তাই দাম বাড়াতে হয়েছে। তবে খামারিরা বলছেন, গরুর দাম আগের মতোই আছে। পশুখাদ্যের দামও নতুন করে বাড়েনি। ফলে মাংসের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রামখারুয়া গ্রামের খামারি মো. রাজু আহমেদ বলেন, প্রতিমণ মাংস উৎপাদনে আমাদের ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। পাচ্ছি ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। খামার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ মাংসের দাম বাড়ছে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, প্রান্তিক কৃষকরা মূলত ছোট গরু উৎপাদন করেন। আমাদের দেশে যে পরিমাণ গরুর চাহিদা, তার ৪৫ শতাংশ প্রয়োজন হয় কোরবানি ঈদে। বাকি গরু সারাবছর বিক্রি হয়। সারাবছর মাংসের দোকানে ছোট ছোট গরু জবাই করা হয়। এগুলো কখনও বড় বড় খামার থেকে যায় না। গত ঈদে ২৪ লাখ গবাদি পশু বিক্রি না হয়ে খামারে ফিরে গেছে। পশুখাদ্যের দামও এখন বাড়েনি। ফলে মাংসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। সরকার চাইলে সব তথ্য বিশ্লেষণ করে মাংসের একটা দর নির্ধারণ করে দিতে পারে। তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চেয়েছি। যাতে গরুর মাথাপিছু আয় সর্বোচ্চ হয়। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ কমবে, এতে মাংসের দামও কমে আসবে। এখন আমরা একটি দেশি গরু থেকে দেড়শ কেজি মাংস পাই, সেখানে যদি ৩০০ কেজি মাংস আসে, এ জন্য যদি উন্নতমানের জাত দেওয়া হয়, তাহলে খরচ কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, গাবতলীতে একটি হাট হওয়ায় এখানে চলে স্বেচ্ছাচারিতা। ইজারাদাররা মাংস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোর করে বেশি খাজনা আদায় করেন। সরকার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিলে ব্যবসায়ীরা তো সুযোগ নেবেই। মাংস ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কোনো জবাবদিহি নেই।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম বলেন, খামারিরা দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। মাঝখান দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভটা নেন। যদি চামড়ার ন্যায্য মূল্যটা পাওয়া যেত, তাহলে এ টাকা মাংসের দামে কম হতো।
জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ফিডের দাম কমিয়ে আনাসহ মাংসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। দর নির্ধারণের বিষয়েও কথাবার্তা চলছে।

https://www.samakal.com/economics/article/219481