২৪ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৩:৩৯

দ্রব্যমূল্যের ‘দৌড়ে’ আবারও ওষুধ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হলেও ওষুধের দাম ফের বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে দাম বাড়াতে তৎপর ওষুধ শিল্প সমিতি। তারা বলছে, ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর হওয়ায় ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে ওষুধ উৎপাদনে। তাই দাম সমন্বয় জরুরি।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের দাম গত বছর অযৌক্তিকভাবে অনেক বাড়ানো হয়েছে। আবারও দাম বাড়লে চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংকট তৈরি হবে। বিপাকে পড়বে সাধারণ মানুষ। অনেক রোগী প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে পারবেন না। সরকারের তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতায় নকল, ভেজাল আর নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে বিরূপ প্রভাব পড়বে জনস্বাস্থ্যের ওপর।

গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে ওষুধের দাম বাড়ানোর দাবি তোলেন ওষুধ শিল্প সমিতির নেতারা। প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন সালমান এফ রহমান। কোন কোম্পানির ওষুধের দাম কত শতাংশ বাড়াবেন, সে বিষয়ে একটি সম্ভাব্য তালিকা প্রস্তুত করেছেন ব্যবসায়ীরা। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে পাঠানো হবে এ তালিকা।

তবে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কাঁচামালের দাম গড়ে কিছু বেড়েছে। আবার বেশ কিছু ওষুধের কাঁচামালের দাম কমেছে। তবে সেসব ওষুধের দাম কমতে দেখা যায়নি। প্যারাসিটামল তৈরিতে কাঁচামাল কেজিপ্রতি ৯০০ টাকা থেকে কমে ৭০০ টাকা করা হলেও এর দাম কমেনি। এ ছাড়া ওষুধ কোম্পানিগুলো এলসি খোলার ক্ষেত্রে যে জটিলতার কথা উল্লেখ করছে, আসলে ততটা সংকট নেই।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে দেড় হাজারের বেশি এসেনসিয়াল ড্রাগের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় রয়েছে ২১৯টি। এগুলোর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া বছরজুড়ে চলে। তবে গত বছর ডলার সংকটের যুক্তি দেখিয়ে একসঙ্গে অনেক কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়াতে আবেদন করে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম ৫০ থেকে শতভাগ বাড়ানো হয়। আর ৪০ টাকার অ্যামোক্সিলিনের দাম বাড়িয়ে করা হয় ৭০ টাকা এবং ২৪ টাকার ইনজেকশনের দাম ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া মেট্রোনিডাজল, অ্যামোক্সিলিন, ডায়াজিপাম, ফেনোবারবিটাল, এসপিরিন, ফেনোক্সিমিথাইল পেনিসিলিন, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জেনেরিকের ওষুধের দাম বাড়ানো হয় ১৩ থেকে ৭৫ শতাংশ।

সে সময়ও ওষুধের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এদিকে যেসব ওষুধের দাম কোম্পানিগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করে, সে ক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি বাড়িয়ে বাজারে শৃঙ্খলা আনার দাবি দীর্ঘদিনের। তবে এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর দেশে ৮৬ লাখ মানুষ আর্থিক সমস্যায় পড়েন। ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।

ওষুধ শিল্প সমিতির নেতারা বলছেন, ডলার সংকট, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ওষুধ উৎপাদনে। এতে সার্বিকভাবে বেড়ে গেছে ব্যবসার খরচ। অনেক কারখানা পুরোদমে চলছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান সমকালকে বলেন, নতুন করে ওষুধের দাম সমন্বয় না হলে ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ডলারের দাম দীর্ঘদিন ছিলে ৮৪ টাকা, এখন ১৩০ টাকা। বর্তমানে প্রয়োজন অনুযায়ী এলসি করা যায় না। নতুন সরকারকে দাম বাড়াতে বললে সরকার আমাদের ওপর চাপ দেবে, আবার বাজারে ওষুধ পাওয়া না গেলেও চাপ দেবে। তিনি আরও বলেন, ‘ছয় মাস ধরে ডলারের দাম বেশি। বেশি দাম দিয়ে কাঁচামাল আনতে হচ্ছে। আমাদের অনেক বিপদ। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যস্ততা কমলে আমরা তাঁর কাছে যাব।’

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, দেশীয় বাজারে ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে সুলভ মূল্যে বিশ্বের ১৫০টির বেশি দেশে আমরা ওষুধ রপ্তানি করছি। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে বর্তমান আন্তর্জাতিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার সমন্বয় করে ওষুধের দাম নির্ধারণ করা জরুরি।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ডলারের মূল্য বাড়ার কারণে ওষুধ শিল্পের ব্যবসায়ীরা কিছুটা সংকটের মধ্যে রয়েছেন। এভাবে ব্যবসা চলতে পারে না। কোনো ব্যবসায়ী লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন না। সুতরাং ওষুধের দাম বাড়ানো হবে।

নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এখনও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর পায়নি বলে জানান মুখপাত্র ও উপপরিচালক মো. নূরুল আলম। অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, সরবরাহ ঠিক রাখতে বোরো মৌসুমে কৃষকদের ডিজেল বা রাসায়নিক সারে ভর্তুকি দেয় সরকার। তেমনি ওষুধের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে দাম স্বাভাবিক রাখতে পারে। এ ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে, তাদের উৎপাদন খরচ সঠিকভাবে যাচাই করে দেখা জরুরি। কারণ অনেক সময় কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো উৎপাদন খরচ বসিয়ে রসিদ প্রস্তুত করে। নির্ধারিত দামে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে– এটি নিশ্চিত করতে তদারকি বাড়ানো জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি অনুষদের সাবেক ডিন ও ওষুধ প্রযুক্তিবিদ অধ্যাপক এ বি এম ফারুক বলেন, ছয় মাস পর পর ঔষধ প্রশাসনে দাম পুনর্মূল্যায়ন সভা হয়। কাঁচামালের দাম বাড়লে ওষুধের দাম বাড়বে, কাঁচামালের দাম কমলে ওষুধের দাম কমবে। তবে আমাদের দেশে একবার দাম বাড়লে আর কমানো সম্ভব হয় না। এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখন ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে একবার অনেক বেশি দাম নির্ধারণ না করে এটি ঔষধ প্রশাসনকে দেখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েক বছরে মানুষের আয় বাড়েনি। ফের দাম বাড়লে অনেকেই ওষুধ কেনার সামর্থ্য হারাবেন। তাই অন্য উপায়ে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়ে ওষুধের দাম স্থিতিশীল রাখার পক্ষে মত দেন তিনি।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, ‘ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে গত বছর সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম। তবে তারা আমাদের আবেদন আমলে না নিয়ে ওষুধের দাম বাড়িয়েছিল। নতুন করে আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করছেন ব্যবসায়ীরা। ঔষধ প্রশাসনের কাছে আবেদন– দাম কোনোভাবে যেন না বাড়ে। প্রয়োজনে ওষুধের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে চিকিৎসকদের উপঢৌকন এবং ফার্মেসির কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।’

https://www.samakal.com/bangladesh/article/219485