জলবায়ু পরিবর্তন ও গাছপালা নিধনে বিরূপ প্রভাব : সঙ্কেতের যন্ত্রপাতি সংগ্রহের উদ্যোগ : হাওরে লাগানো হচ্ছে দশ লাখ তালগাছ : ‘দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতের মাত্রা বেড়েছে, প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা’ -চুয়েট ভিসি
১২ মে ২০১৭, শুক্রবার, ৪:০৭

বজ্রপাতে বাড়ছে আতঙ্ক ও মৃত্যু

বাংলাদেশে দুর্যোগে নতুন মাত্রা বজ্রপাত। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাত, বজ্রবৃষ্টি, বজ্রঝড়ের ব্যাপকতা বেড়ে গেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেড়েছে। বাড়ছে প্রাণহানিও। বজ্রপাত ঘিরে জনমনে ভয়-আতঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক দশকে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ২ হাজার ৩৫৬ জন। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। বজ্রাঘাতে বাথানের গবাদিপশু মারা পড়েছে অসংখ্য। গত মঙ্গলবার একদিনেই দেশের ১৫টি জেলায় বজ্রপাতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের। বজ্রপাত, বজ্রঝড়ের আধিক্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি দায়িত্বশীলদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। দেশে বজ্রপাতের মাত্রা কেন বেড়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম গতকাল বুধবার দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতের মাত্রা এখন বেশি। এতে প্রাণহানি রোধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা এক্ষেত্রে সহায়ক। বজ্রপাতের হার বৃদ্ধির কারণগুলো উল্লেখ করে বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরূপ প্রভাব তো আছেই। সেই সাথে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খোলা জায়গা ও ডোবা-জলাশয় ভরাট, বন-জঙ্গল কমে যাওয়া বিশেষত তাল, সুপারি, নারকেল গাছের মতো উঁচু উঁচু গাছপালা হ্রাসের কারণে বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়ে যাচ্ছে। এসব বজ্র-নিরোধক প্রাকৃতিক ‘টাওয়ার বৃক্ষ’ বজ্রপাতকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর প্রাকৃতিক ক্ষমতা রয়েছে। অতীতে এসব উঁচু গাছে বাজ পড়তে দেখা যেতো।
চুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস (ইইই) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাইভোল্টেজ বিশেষজ্ঞ অশোক কুমার সেনগুপ্ত ইনকিলাবকে জানান, বজ্রপাতের প্রবণতা বেড়ে গেছে এটা সত্যি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নও এর জন্য দায়ী। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার একজন গবেষক জানিয়েছেন, ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বজ্রপাত ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে খোলা জায়গায় কাজকর্ম ও চলাচল বেড়ে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার (লাইফস্টাইল) পরিবর্তন যেমন- মোবাইল সেলফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর (গেজেট) মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারও অনেকটা দায়ী। এ ধরনের কোনো কোনো যন্ত্রপাতি বজ্রকে উপর থেকে মানুষের দিকে টেনে নিয়ে এসে বিপদ ঘটাতে পারে। তাছাড়া শহর-নগরে সারি সারি বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে। সেসব অধিকাংশ উঁচু ভবনে বজ্র-নিরোধক না থাকায় আশপাশে খোলা জায়গা থাকলে সেখানে বজ্রপাত হচ্ছে।
কিভাবে বজ্রপাত-
চুয়েটের ভিসি অধ্যাপক ড. মোঃ রফিকুল আলম জানান, সাধারণ কথায় মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বজ্র এবং তা মাটির সংস্পর্শে এলেই বজ্রপাত হয়। বজ্রের ভেতরে ৫০ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত ভয়াবহ তাপমাত্রা বা ‘সুপার হিট’ তৈরি হয়। যার শব্দ ১০ মাইল দূর থেকেও শোনা যায়।
আকাশে বিদ্যমান জলকণাগুলোতে চার্জ সঞ্চিত হওয়ার কারণে বিপরীত পোলারাইজেশন তৈরি হয়। আর জলকণায় ব্যাপক চার্জ হওয়ার কারণে যখন তা ধরে রাখতে পারে না, নিচের দিকে চলে আসে, বজ্রপাত হয়। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে তাপদাহে বজ্রপাত বেশি হারে হচ্ছে। বজ্রপাতের হার আরো বাড়লে মানুষ হতাহতের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।
বাড়ছে বজ্রপাত
প্রকৃতির আপন নিয়মের ধারায় বজ্রপাত আগেও ছিল। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর একটি। তবে বাংলাদেশেও বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি মে মাসের আবহাওয়া পূর্বাভাস বলছে, দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২-৩ দিন বজ্রসহ মাঝারি থেকে তীব্র আকারে কালবৈশাখী বা বজ্রঝড় এবং দেশের অন্যত্র ৩-৪ দিন হালকা থেকে মাঝারি আকারে কালবৈশাখী বা বজ্রঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত মে মাস থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রাক-বর্ষা ও বর্ষা মৌসুমে শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ায় হঠাৎ আকাশে মেঘ জমলে বজ্রপাতের ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকে। খোলা মাঠে-ময়দানে, বিলে, হাওর-বাওরে, নদীতে খোলা জায়গায় বজ্রপাত সরাসরি আঘাত করতে পারে এবং এতে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। এর ফলে প্রধানত কৃষক-কিষাণী, জেলে ও মাঝি-মাল্লা, শ্রমজীবি, পথচারীসহ খোলা জায়গায় বিচরণকারী মানুষ বজ্রপাতের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। তাই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন গুমোট হয়ে আসলে কিংবা বৃষ্টির সময় এ ধরনের খোলামেলা জায়গা এড়িয়ে বাড়িঘরে নিরাপদ স্থানে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞগণ। বিভিন্ন হিসাব মতে গত এক দশকে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ২ হাজার ৩৫৬ জন। এরমধ্যে বিগত ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩০১ জন, ২০১৩ সালে ২৮৫ জন, ২০১৪ সালে ২১০ জন, ২০১৫ সালে ২৭৮ জন এবং গতবছর (২০১৬) এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৫০ জন।
যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও তালগাছ-থেরাপি
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশের প্রযুক্তিতে বজ্রপাত বজ্রঝড়ের ‘আশঙ্কা’র পূর্বাভাস দেয়া যায়। কিন্তু বজ্রপাতের ক্ষণ সম্পর্কে সঠিক ও সুনির্দিষ্টভাবে আধুনিক প্রযুুক্তিতে পূর্বাভাস দেয়ার ব্যবস্থা নেই। এর জন্য দেশে উন্নততর প্রযুক্তিরনে বজ্রপাত নিরোধক ও আগাম সংকেত প্রদানকারী যন্ত্রপাতি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে একদল কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। দেশে হাওর, বিল বাওর এলাকায় খোলা জায়গা বেছে বেছে সরকারি উদ্যোগে ১০ লাখ তাল গাছ লাগানোর কাজ চলছে। বিশেষ প্রকল্পের আওতায় এসবের পাশাপশি ঢাকায় এবং হাওর অঞ্চলে বজ্রনিরোধক টাওয়ার স্থাপনের কাজে হাত দেয়া হবে শিগগিরই।
আবহাওয়া বিভাগ বলছে, বজ্রপাত থেকে রক্ষায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের অ্যাপস থেকে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা আগেই বজ্রপাত, বজ্রঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাবে। গুগল প্লে স্টোরে (ইগউ ডবধঃযবৎ অঢ়ঢ়) অ্যাপসটি পাওয়া যাবে। অ্যাপসটি ডাউনলোড করে মোবাইল ফোনে ইনস্টল করলে যে যে জেলায় বজ্রপাত হওয়ার আশংকা রয়েছে সেখানে থান্ডারস্ট্রম নোটিফিকেশন লেখা থাকবে। তাছাড়া ‘১০৯৪১’ নাম্বারে কল করে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা পূর্বে বজ্রপাতের তথ্য পাওয়া যাবে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ অশোক কুমার সেনগুপ্ত বলেছেন, বজ্রপাত প্রাকৃতিক ঘটনা। বাংলাদেশে মে-জুলাইয়ে শুষ্ক আবহাওয়ায় বজ্রপাত হয় বেশি। ভরা বর্ষায় বজ্রপাত কম হয়। সাধারণ কিছু সতর্কতা মেনে চললে এই দুর্যোগে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। আমাদের দেশের মতো অনুন্নত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুহার বেশি। কেননা বাইরে খোলামেলা জায়গায় থাকা কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা বেশি। বজ্র নিচের দিকে নেমে আসার অল্পক্ষণ আগে (কেউ বাইরে থাকলে) শরীরের লোম, চুল হঠাৎ খাড়া হয়ে উঠতে পারে, যা বজ্রপাতের পূর্ব-লক্ষণ। তখনই দৌড়াদৌড়ি না করে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে (মাতৃজটরে থাকা সন্তানের মতো) থাকলে বিপদ এড়ানো যেতে পারে। বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার বিপজ্জনক হতে পারে। ধারে কাছে কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেও বিপদের শঙ্কা আছে।
তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের দেয়া আরও পরামর্শের মধ্যে রয়েছে-
১) আকাশে ঘনকালো মেঘ দেখা দিলে বজ্রপাতের আশংকা তৈরি হয়। ৩০-৪৫ মিনিট বজ্রপাত স্থায়ী হয়। এ সময় ঘরে অবস্থানই নিরাপদ।
২) ঘনকালো মেঘ দেখা দিলে খুব প্রয়োজন হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়া যেতে পারে।
৩) বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে থাকা নিরাপদ নয়। গাছের তলায় থাকা বিপজ্জনক।
৪) যতদ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। টিনের চালা এড়িয়ে যেতে হবে।
৫) উঁচু গাছপালা বৈদ্যুতিক তার ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে হবে। পরিহার করতে হবে ধাতব মাথা বের করে থাকা ছাতা। প্লাস্টিক বা কাঠের ছাতা ব্যবহার করা যাবে।
৬) বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না। সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
৭) এ সময় বাড়িঘরে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দা পরিহার করতে হবে। বাড়ির জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ধাতব কল, সিঁড়ি, পাইপ স্পর্শ না করা নিরাপদ।
৮) বজ্রপাতের সময় সমুদ্র সৈকতে থাকা এবং ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া নিরাপদ নয়। তবে এ সময় নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করা উচিত। পানি থেকে দূরে থাকতে হবে।
৯) প্রত্যেকটি ভবনে বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপন ও আর্থিং ব্যবস্থা থাকা নিশ্চিত করতে হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/79046/