২৩ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ৬:৫২

স্বাধীন বাংলাদেশ: আমাদের অস্তিত্বের স্মারক, আমরা এটাকে হারাতে পারি না 

-আবদুল্লাহিল মামুন আল-আযমী

সম্প্রতি বাংলাভাষা এবং বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা অন্যতম পুরোধা অধ্যাপক গোলাম আযমের বড় ছেলে  মামুন আল-আযামী নিউইয়র্ক সফরে আসেন। ২০২৩ সনের ১০ নবেম্বর নিউইয়র্কের জ্যামাইকাস্থ মুনা মুসলিম সেন্টারে তার সাথে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকারের দুর্লভ সুযোগ হয়, যা নিচে বিবৃত হলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকারী মামুন আল-আযামীর কাছে জানতে চাই: মাদরাসায় না পড়েও কীভাবে তিনি কুরআন-হাদিসে বিশারদ হয়ে গেলেন।

তিনি জানান, ৫১ বছর ধরে  বিদেশে বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের, বিশেষত ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে ২০ বছর কর্মরত থাকাকালীন সহকর্মীদের উৎসাহে ও সহযোগিতায় এবং সেখানে বক্তব্য দেয়ার দায়িত্ব পালন করার তাগিদে আমাকে পবিত্র কুরআন-হাদিস চর্চায় মনোনিবেশ করতে হয়।

তিনি বলেন, এটা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য বিশেষ। আমার আব্বাও ডচ্চতর শিক্ষা মাদরাসায় পড়েন নি। আমরা ছয় ভাইয়ের কেউই মাদরাসায় পড়ে নি। কিন্তু আমরা সবাই কোরআন-হাদিসে কিছুটা দক্ষতা অর্জন করেছি এবং আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন যথাসম্ভব কুরআন-হাদিসের আলোকে পরিচালিত হয়।

আমার আব্বা ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। তিনি তারা পুরো জীবনে ১৩৮টি ছোট-বড় বই লিখেছেন। তাদের অধিকাংশই কুরআন-হাদিস সংক্রান্ত। কুরআন-হাদিসের সাথে মানুষের জীবন পরিচালনার গুরুত্ব সংক্রান্ত ।

কুরআন-হাদিস তথা ইসলামের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসলাম মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। তাই মহান আল্লাহই মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)’এর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন মানুষের পুরো জীবনে যা যা করা দরকার সেগুলোর রূপরেখা পাঠিয়েছেন।

অধ্যাপক আযম কোরআন-হাদিসের বাণী উদ্ধৃত করে বলেছেন, মানব জীবনে এমন কোন দিক নেই, যে ব্যাপারে কুরআন-হাদিস তথা আল্লাহর কোন নির্দেশনা নেই। রাজনীতি মানুষের জীবন হতে বিচ্ছিন্ন নয়। সুতরাং রাজনীতিকে ইসলাম হতে বাদ দেয়ার কোন সুযোগ নেই, কমপক্ষে মুসলমানরা তো কোনভাবেই রাজনীতি থেকে ইসলামকে বাদ দিতে পারে না।  কোন কোন কাজ গ্রহণীয় কিংবা বর্জনীয় তা কুরআন-হাদিসের আলোক স্থির করতে হবে।

তারই সুযোগ্য সন্তান ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম সেনানী আব্দুল্লাহিল মামুন আল-আযামী বলেন, আমাদেরকে ইসলামের চর্চা করতে হবেই হবে, ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে। পবিত্র কুরআনের সুরা মায়েদাসহ বিভিন্ন সুরায় মানুষকে ইসলামের দিকে আসার জন্য দাওয়াত দিতে বলা হয়েছে। অনেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে কথা ও কাজে অমুসলিমের মতো আচরণ করে। মুসলিম রাজনীতিকরা তো এমন হতে পারেন না। রাজনীতিকরা ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সব ধরনের অপকর্ম তথা কুরআন-হাদিসের আদর্শবিরোধী কর্মকা- বন্ধ হয়ে যাবে।

সুরা আননিছার ৭০-৭১ আয়াতে মানুষকে সব ধরনের নির্যাতন থেকে দূরে থাকতে  বলা হয়েছে। মুসলমানদের সবক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সুরা আল-ইমরান’এর ১০৩  ও ১০৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা একসাথে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর। বিচ্ছিন্ন হয়ো না। একই সুরার ১১০ আয়াতে বলা হয়েছে তারাই শ্রেষ্ঠ যারা সৎকাজে  করে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে। সুরা সাফ’এর ৯ নং আয়াতে মানুষকে তওবা করতে বলা হয়েছে। সুরা তওবা ও ফাতাহ’তে আল্লাহ শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ  (সাঃ) কে প্রেরণ করেছেন তার আগের অন্যসব জীবন বিধানের উপরে বিজয়ী করার জন্য।  

সুরা বনী-ইসরাইল’এর ২৩ থেকে ৩৮ আয়াত রাষ্ট্রের রূপ-রেখার প্রসঙ্গে  বলা হয়েছে। সুরা আশশুরা’র ১৩ আয়াতে মহান আল্লাহ মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ)’এর উদ্দেশ্যে বলেছেন: আমি নূহ, ইব্বারাহীম, মুসা’কে যে আদেশ করেছিলম, আপনাকেও একই আদেশ দিচ্ছি। ওইসব নির্দেশ ছিল দ্বীন-ইসলাম কায়েমের। সুরা হজ্জ্বের ৪১ আয়াতে আল্লাহ শাসকদের বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদানের পর যেন চারটি কাজ অবশ্যই কায়েম করেন। এগুলো হলো: নামায কায়েম করা, যাকাত প্রতিষ্ঠা করা, সৎকাজে আদেশ দেয়া এবং অসৎকাজ নিষেধ করা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার উপায় কি, এমন প্রশ্নের জবাবে এই ইসলামী চিন্তাবিদ বলেন, ব্যক্তিগত, পরিবারিক ও সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকা- কুরআন-হাদিসের আলোকে হতে হবে। ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ইসলামী জিন্দেগী অনুস্বীকৃত হলে রাষ্ট্রীয় জীবনে তা  বাস্তবায়িত হবার ভিত্তি হবে। অনৈতিক কাজে যারা অভ্যস্থ হয়ে গেছে তাদেরকে সংশোধন  করার সুযোগ ও সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।

উত্তম কাজের আহ্বানকে অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদেরকে সংশোধনের জন্য সময় দিতে হবে। তাদেরকে ভালোকাজের জন্য নির্দেশ এবং মন্দকাজের বেলায় নিরুৎসাহিত তথা নিষেধ করতে হবে। বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও কেউ সংশোধিত তথা ইসলামের পথে না আসলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিনি তার আব্বা মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমকে কীভাবে দেখেন এমন প্রশ্ন করা হলে  তিনি বলেন, আমি তার জন্য গর্বিত। তিনি ভাষা আন্দোলনের সম্মুখসারির অগ্রদূত ছিলেন। তিনিই ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ছাত্র সংসদ)’এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া মানপত্রে বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান। ভাষার দাবিতে অটল থাকার জন্য (১৯৪৮) সনে ও ১৯৫৫ সালে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। এছাড়া খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালীন ১৯৫২  সালে বাংলা ভাষার আন্দোলন করার জন্য তাকে পুনরায় কারারুদ্ধ হন। ওই সময় তিনি রংপুরের কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনার পেশায় যুক্ত ছিলেন। ওই কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে সরকার তাকে মুক্তি দিতে এবং তার চাকরি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হলে আমার আব্বাকে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি হিসেবে স্বীকার করতেই হবে।

জনাব আযামী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস বইতে তার অনন্য অবদানের কোন স্বীকৃতি নেই, যা তিনি পাকিস্তান আমলেই রেখেছিলেন। এমনকি ডাকসু ভবনে রাখা ডাকসু ভিপি ও জিএসদের নামের তালিকা থেকে তার নাম মুছে ফেলা হয়েছে। এমন পদক্ষেপ ডাকসুর ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করেছে।

আযামী বলেন, আমার আব্বা বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাবক এবং তার জীবদ্দশায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন । তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই দাবি মেনে নেন। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশসহ দেশে-বিদেশের  রাজনীতিকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশে বেশ ক’টি সর্বজনগ্রাহ্য স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটাও আমার আব্বার অন্যতম কৃর্তিত্ব।

রাজনীনৈতিক কারণে আপনাদের পরিবার কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আযামী বলেন, আমাদের পরিবার কীভাবে চরম মূল্য দিচ্ছে তার প্রমাণ আমার মেঝোভাই বিগ্রেডিয়ার আবদুল্লাহিল আমান আযমী। বিনা কারণে ও অকালে তার চাকরিচ্যুত হওয়া এবং তাকে গভীর রাতে আমাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

তিনি বলেন ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট আমার ভাইকে চোখ বেঁধে অপমানজনভাবে আমাদের পৈত্রিক বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কী না,  তা নিশ্চিত নই। বেঁছে থাকলে তিনি কোথায় আছেন, বাংলাদেশে নাকি ভারতে তাও জানি না। বছর খানেক আগে এক অনলাইন সাক্ষাতকারে কর্ণেল হাসিনুর রহমানকে বলতে শুনেছি তিনি আমার ভাইকে আয়না ঘরে (ডিজিএফআই’এর নির্যাতন কেন্দ্র) দেখেছেন।

তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, আমাদের পরিবারের কোন সদস্য কোন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত নন। আমরা রাজনৈতিক কর্মকা-ের সাথেও জড়িত নই। আমরা কোন দলের বা ব্যক্তির প্রতিদ্বন্দ্বীও নই। আমরা পেশাজীবী। আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে ভালোবাসি। এর পৃথক অস্তিত্ব, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমরা দুনিয়ার যেখানেই থাকি আমাদের মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে, যে মাটির সাথে আমাদের পূর্বপুরুষরা মিশে আছেন। আমরা বাংলাদেশের শান্তি-সমৃদ্ধি কামনা করি। আমরা চাই এই দেশ টিকে থাকুক অনন্তকাল পর্যন্ত। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের অস্তিত্বের স্মারক। আমরা এটাকে হারাতে পারি না।*  

আবদুল্লাহিল মামুন আল-আযমীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

মামুন আল-আযমী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমের প্রথম সন্তান। বহুভাষাবিদ মামুন আল-আযামী একজন ইসলামিক প-িত। ১৯৫৩ সনে তার জন্ম। তিনি লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।  দীর্ঘদিন ইসলামিক ডেভেলপম্যান্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন অবসর নিলেও বাস্তবে তার অবসর নেই। বছরের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময় সেমিনারে, সমাবেশে পবিত্র কুরআন-হাদিসের ওপর গবেষণামূলক বক্তৃতা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ান। কমপক্ষে ৭টি ভাষাভাষী মানষের কাছে তিনি কুরআন-হাদিসের বাণী পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে তার সুখ্যাতি, জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। 

সাক্ষাৎকার গ্রহণে: মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, নিউইয়র্ক, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।

https://www.dailysangram.info/post/546854