১২ মে ২০১৭, শুক্রবার, ৩:৩৭

ভোটার মনের দ্রোহটা কে বুঝবেন

বিবিধ প্রসঙ্গ

|| মাসুদ মজুমদার ||

আমরা প্রধান বিচারপতির বক্তব্য যেমন উপভোগ করছি না, তেমনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও নির্দ্বিধায় হজম করতে পারছি না। হাইকোর্ট থেকে বঙ্গ ভবন ও গণভবনের দূরত্ব কত লাখ কিলোমিটার সেই মাপজোখ করার গরজও জনগণের নেই। দুর্ভাগ্য, কেউ গণমানুষের ‘মন’ বুঝতে চাইছেন না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আইনের শাসনের অর্থ যা, জনগণের কাছে তা নয়। বিচার বিভাগ যে স্বাধীন, তার সূচক নাকি রিট মামলার সংখ্যা এবং ১৪০ বার খালেদা জিয়াকে সময় দান। হায়রে কপাল! আড়াই বছর কেন ফাইল চলে না? অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের বারবার সময় চাওয়ার বিষয়টিও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রমাণ কি না সেই প্রশ্নের জবাব কার কাছে খুঁজব?
নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের কথা ভাবছে। বাংলাদেশের মানুষ ক’দিন আগে থেকেই ভোটের গন্ধ পাচ্ছে। কখন কিভাবে কার অধীনে নির্বাচন হবে তা নিশ্চিত করে জানে না। ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তাও পাচ্ছে না। রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনী বিতণ্ডায় জড়িয়ে ‘সুখ’ পাচ্ছেন। অথচ জনগণ নাগরিক অধিকার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। অধিকারগুলো খর্ব হতে হতে এমনভাবে সঙ্কুচিত হয়ে আসছেÑ মানুষ ভাবছে, ব্যক্তিমানুষ আজ কতটা স্বাধীন? দাসত্ব আর প্রাপ্ত স্বাধীনতার মাঝে ফারাকটাই বা কত বড়!
‘আঙ্কেল টমস কেবিন’ সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন, তারা জানেন আঙ্কেল টম কে? এই ঐতিহাসিক চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন লেখিকা হ্যারিয়েট বিচ্যার স্টো। যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসতা নিয়ে লেখা এই জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র টম একজন মানবিক ও নৈতিক গুণসম্পন্ন দাস। টম রক্তমাংসের মানুষ। ভালোমন্দের ফারাক বোঝে। তার ধর্মমানস ও উদার মন অসাধারণ। তার সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস ও আস্থার কোনো তুলনা হয় না। উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিষয়Ñ দাসপ্রথা কতটা নিষ্ঠুর অমানবিক এবং মানবতার সাথে সাংঘর্ষিক, এই বক্তব্যটি জোরালোভাবে তুলে ধরা। নির্যাতিত এবং নিপীড়িত একজন পরিণত বয়সের দাস আঙ্কেল টমের মুখ দিয়ে লেখিকা বলিয়েছেন, ‘আমি দাস, আপনি মনিব। আমার দেহটা আপনার, যা ইচ্ছা করতে পারেন। মনটা আমার নিজের। আমার মনটি আপনি কিনতে পারেননি। এই মন কেনার কিংবা মূল্য দেয়ার সামর্থ্য আপনার নেই। যার সামর্থ্য আছে তিনি অনেক আগেই আমার মন কিনে নিয়েছেন।’ টম মনে করেনÑ মানুষের মন কেনার সামর্থ্য আছে শুধু আল্লাহর। টম তার স্নেহভাজন এক দাসীকে নৈতিকতার সবক দিতে গিয়ে বলছেন, ‘কোনো খারাপ কাজ দিয়ে ভালো কাজের সূচনা করা যায় না’। এই দাসী তার মনিবের নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণে বিুব্ধ হয়ে আঙ্কেল টমের কাছে মনিবকে হত্যার অনুমতি চাইতে গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ন্যাশনাল এরা’ পত্রিকায় আঙ্কেল টমস কেবিন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে ১৮৫১ সালের ৫ জুন থেকে, শেষ হয় ১৮৫২ সালের ১ এপ্রিল। বই আকারে প্রকাশ পায় ১৮৫২ সালেই। হ্যারিয়েট হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রিত হন ১৮৬২ সালের ২০ নভেম্বর। কালজয়ী এই উপন্যাসটি দাসপ্রথার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি এবং এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে শুধু জনমত সৃষ্টি করেনি, আইনের মাধ্যমে এই প্রথা বিলুপ্তিতে অবদানও অনেক রেখেছে। ১৮৬৩ সালে আমেরিকা দাসপ্রথা উচ্ছেদের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়। ১৮৬৫ সালের ডিসেম্বরে সেটি আইনগত ভিত্তি পায়। ১৯১২ সালের ২৭ জানুয়ারি আমেরিকা থেকে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে।
এই ভূমিকাটুকু টেনে আনলাম আমাদের রাজনীতির সদর অন্দরে যেসব নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ প্রত্যক্ষ করছিÑ যা দাসপ্রথার চেয়েও জঘন্য, অমানবিক এবং মানুষের মর্যাদার জন্য লজ্জাজনক, সে সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত করার জন্য। আপনারাই বলুন, আক্ষরিক অর্থে দাসপ্রথার সামগ্রিক বিলুপ্তি ঘটেছে কি? বারবার মনে হয়, দাসপ্রথার ধরন পাল্টেছে কিন্তু দাসত্বের বিলুপ্তি ঘটেনি। সরকার ও রাজনীতিবিদেরা মানুষের মনের তোয়াক্কা করছেন না। দেশের মানুষের মন কেন বিগড়ে আছে, তা বুঝতে চাচ্ছেন না। মনের খোরাকগুলো কেড়ে নিয়ে উন্নয়ন খয়রাতে কোনো মানুষ সন্তুষ্ট হয় না। এটাই পশু ও মানুষের মৌলিক পার্থক্য, যা শাসকেরা আমলে নিচ্ছেন না। বর্তমান সরকার বিগত কয়েক বছরে মানুষের মন ভীষণভাবে বিগড়ে দিয়েছে। কত লোক ওএসডি হয়েছে, কত মানুষকে রাজনৈতিক কারণে উপেক্ষা করা হয়েছে; বিভিন্ন ইস্যুতে শত শত পরিবারে কান্নার মাতম শোনা গেছে। মামলায় বিপন্ন হাজারো মানুষ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর ওপর কোন নির্যাতনটি বাকি আছে? হত্যা, খুন, গুম থেকে চাঁদাবাজিতে অসংখ্য মানুষ ুব্ধ। তাদের কেউ মনটা তো বিকিয়ে দেয়নি।
আগের দিনে দাসরা গতর খেটে পরাধীনতার মধ্যে কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করেছে। এখন শ্রম ও মগজ বিক্রি করে রাষ্ট্রযন্ত্রের যাঁতাকলের ভেতর মানসিক দাসত্ব বা গোলামির সাথে বসবাস করতে বাধ্য হয়। এখন জীবন, জীবিকা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার পুরোটাই অনিশ্চিত। দাসরাও শ্রমের বিনিময়ে খেতে পেত, প্রভুর শর্তহীন আনুগত্য করে বাঁচার নিশ্চয়তা পেত। সেটা হতো জীবন রক্ষার জন্য, যে জীবন ছিল মানবেতর। এখন আমরা অসংখ্য রীতিনীতি-আইনকানুন এবং ‘রাজনৈতিক দেবতা’ কিংবা প্রভুদের নিয়ন্ত্রণে। আইনে জীবনের নিশ্চয়তার কথা আছে। মানবিক মর্যাদার কথাও কেতাবে আছে। মানবিক ও মৌলিক অধিকারের সুবচনগুলোও বইয়ের পাতায় রয়েছে। বাস্তবে ইনসাফ আর আইনের শাসনের অভাবে অসংখ্য মানুষের কান্নাকাতর অবস্থার আর্তধ্বনি ক’জনই বা শুনতে পান! রাজনৈতিক প্রভুরা দণ্ডমুণ্ডের মালিক। তাদের ইচ্ছায় সব কিছু চলে; নিয়ন্ত্রিত হয়। গুম হয়, সরকার দায় নেয় না। অপহরণ ভিন্নমত জব্দ করার আরেক কৌশল।
প্রধান বিচারপতি আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বলেন, আইনের শাসনের ঘাটতি না থাকলে তাকে এত কথা বলতে হতো না। প্রধান বিচারপতির সাধারণ ভাবমর্যাদার সাথে হয়তো এত কথা মানানসই নয়, তার পরও তার এই বক্তব্যটির সাথে একমত না হয়ে উপায় আছে কি? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে যখন নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিমরোলার চালানো হয়, তখন কি দাসদের ওপর মনিবের বর্বরতার কথা মনে পড়ে না? মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের চোখ থাকে বন্ধ, কানে থাকে তালা। পালক কন্যার ইজ্জত-আব্রু ও জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে বাবা-মেয়ে ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দিয়ে আমাদের সমগ্র জাতিকে দায়বদ্ধ করে গেলেন। ভালো কথাÑ এই ইস্যুতে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের ঘুম ভাঙল। অ্যামনেস্টি যা দেখে, টিআইবি যা বুঝে, তা কি মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান দেখেন না, বুঝেন না? আইন ও বিচারের আওতায় না এনে কখনো জঙ্গি, কখনো সন্ত্রাসী, কখনো বা উগ্রবাদী বলে মানুষকে লাশ বানিয়ে দেয়া কোন ধরনের আইনের শাসন? জঙ্গি ইস্যুতে শিশু-নারী যারা মারা গেল, বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার মানুষগুলোর কাছে দাসপ্রথার অর্থ কি ভিন্ন কিছু? দাস মালিক ক্রীতদাসের দণ্ডমুণ্ডের মালিক ছিল। আমাদের দেশের ভিন্নমতের মানুষগুলোর দণ্ডমুণ্ডের মালিক কি অচেনা কেউ?
দেশে শাসক-শাসিতের সম্পর্কের ধরন অনেকটা দাসযুগের মনিব ও দাসের মতো। দাসরা মতের স্বাধীনতা পেত না, অবাধ বিচরণ করতে পারত না, মতামত দিতে পারত না। বর্তমানে স্বাধীন মানুষ কতটা পারছে? দলতন্ত্র ও চাটার দলের কাছে কে জিম্মি নন? দলীয় ক্যাডার ও সন্ত্রাসী চক্রের কাছে কে অসহায় নন? সেবা খাতে বঞ্চনার শেষ নেই। টাকা দিয়েও সেবা কেনা যায় না। দাসদের শুধু মৃত্যুর অধিকার ছিল, বাঁচার নিশ্চয়তা ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতি অনেক বেশি উন্নত নয়। ভারতে হরিজন খ্যাত দলিতরা মানুষ নন, দলিত। গান্ধীজি আদর করে দলিতদের হরিজন বলে ছিলেন।
কিন্তু তাদের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারেননি। ভারতে এখন সবচেয়ে নিগৃহীত হচ্ছে নি¤œবর্ণের মানুষ মুসলমান। প্রায় একই সমতলে রয়েছে দলিত বা নমঃশূদ্ররা। খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখরা মুসলমানদের তুলনায় কিছুটা ভালো। হিন্দুত্ববাদে বর্ণহিন্দুরা মনিব, অবশিষ্ট সবাই মেøচ্ছ যবন এবং দাস। ঈশ্বর নাকি বর্ণবাদী হিন্দুদের সেবায়েত হিসেবেই তাদের সৃষ্টি করেছেন।
একসময় কালো মানুষদের মনে করা হতোÑ ওদের জন্মই হয়েছে সাদা মানুষদের দাস হিসেবে। এখন কালোরা মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু তাদের মানবিক অধিকার পুরোমাত্রায় নিশ্চিত করা যায়নি। নেলসন ম্যান্ডেলা অমর হলেন কালো মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রামের জন্য।
আব্রাহাম লিংকন অমর হলেন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য সাহসী উদ্যোগ নিয়ে। ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’ লেখার পর বইটি মার্কিন সমাজকে জাগিয়ে দেয়। আব্রাহাম লিংকন নিজেই লেখিকা হ্যারিয়েট বিচ্যার স্টোকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, এই ছোটখাটো একজন ভদ্রমহিলা দাসপ্রথা বিলোপের পক্ষে যুদ্ধ শুরু করতে জাতিকে প্রেরণা জুগিয়েছেন।
একসময় একজন মার্কিন দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ অকপটে বলেছিলেন, নবী মোহাম্মদ সা: দাসপ্রথা বিলুপ্তির পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছেন। নবী ঈসা আ:-এর অনুসারী আব্রাহাম লিংকন আইনি উদ্যোগে এর সমাপ্তি টেনেছিলেন। আফ্রিকায় বর্ণবাদের নামে দাসপ্রথার অক্টোপাসটা রদ করলেন কৃষ্ণসুন্দর ম্যান্ডেলা। ভারতে বর্ণবাদ ঠেকানোর জন্য একজন অবতারের জন্ম অনিবার্য করে তুলেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। যে দেশে মানুষের চেয়ে গরুর মর্যাদা বেশি, সেই দেশ যে দাসপ্রথার মধ্যযুগে ফিরে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ তাদের বর্ণবাদী চরিত্র আড়াল করতে পারেনি; হিন্দুত্ববাদের নামে উন্মাদনা ঢাকতে পারেনি। তাই মানবতাবাদী কোনো মানুষের উত্থান না ঘটলে এই সমাজের নিষ্কৃতি নেই। একইভাবে বাংলাদেশে দৃঢ়চেতা, সৎ, সাহসী ও দেশপ্রেমিক একজন রাজনৈতিক সংস্কারক কিংবা নেতা না এলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন সুদূরপরাহত। মানুষকে দাসতুল্য অনুগত না ভেবে নাগরিক ভাবার মতো রাজনীতিবিদের বড্ড অভাব।
ছয় লাখ কোটি টাকা পাচারের দায় কেউ নিচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা সবাই ভুলে গেছে। অব্যাহত আর্থিক দুর্নীতি, ব্যাংকের অর্থ লোপাট নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। সরকার গ্যাসের দাম বাড়াতে চায়। বিদ্যুৎ নিয়েও জনগণের সাথে বাণিজ্য। ঢালাও ভ্যাট নিয়েও বাড়াবাড়ি প্রান্ত ছুঁয়েছে। চালের দাম নিয়ন্ত্রণহীন। অন্য পণ্যের দামও যুক্তিহীনভাবে বাড়ছে। এতেও ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক চাতুর্যের শেষ নেই। তার পরও উন্নয়ন ও সাফল্যের ডুগডুগিবাজরা অধিকার হরণ করে অনুতপ্ত নন। তারা ভোটের বাজারে মানুষের মন পাবেনÑ এমনটি আশা করা কতটা যৌক্তিক?
masud2151@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/219054