১০ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:১৯

বহুজাতিক কোম্পানির দৌরাত্মে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা

বহুজাতিক কোম্পানির দৌরাত্মে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে দেশীয় উদ্যোক্তারা। বেশি দামে মুরগির বাচ্চার আর খাদ্য কিনে পুষিয়ে উঠতে পারছে না প্রান্তিক খামারিরা। এতে করে লোকসানের মুখে খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে কৃষকরা। তাদের দাবি প্রতিটি ডিম উৎপাদনে ব্যয় ৭ টাকা। অথচ বিক্রি করতে হচ্ছে ৫ টাকায়। প্রতিটি ডিমে লোকসান হচ্ছে ২ টাকা। ঋণের জালে আটকে পড়া এসব খামারি আন্দোলনে নামতে বাধ্য হচ্ছে।
জানা গেছে ডিমের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে খামারিরা রাস্তায় ডিম ভেঙ্গে প্রতিবাদ করছে। গত রোববার গাজিপুরের চন্দ্রায় খামারিরা এ অভিনব প্রতিবাদ করেন। একইভাবে রাজশাহীসহ সারা দেশের খামারিরা এভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অভিযোগ বহুজাতিক কোম্পানির কারণেই তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। তাছাড়া ১ দিনের বাচ্চা, খাদ্য এবং ঔষধের দাম যে হারে বাড়ছে সে হারে ডিমের দাম বাড়ছে না। এতে করে ঋণের জালে আটকে পড়ছে এসব প্রান্তিক খামারিরা। সরকার যদি এসব খামারিদের বাঁচাতে কোন ব্যবস্থা না নেয় তাহলে বড় ধরনের আন্দোলন করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না তাদের।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১ দিনের একটি বাচ্চা ক্রয় করতে হয় ৮০ টাকা দিয়ে। একটি ব্রয়লার বিক্রিযোগ্য করতে সময় লাগে ৩৫-৪০ দিন। এসময়ে ১ টি মুরগিতে খরচ হয় ৬০ টাকা। প্রতিটি মুরগির মূল্য পড়ে ১৪০ টাকা। আর এক কেজি মুরগির দাম পড়ে ১৩০ টাকা। তবে মুরগি যদি এক কেজির বেশি হয় তাহলেই খামারি লাভ পেয়ে থাকেন। আর যদি রোগ বালাই পেয়ে বসে তাহলে পুরো বিনিয়োগই শেষ হয়ে যায়। একইভাবে লেয়ারের একটি বাচ্চার মূল্য ৭০-৮০ টাকা। ডিমের উপযুক্ত করতে এতে আরও খরচ হয়ে থাকে ১৫০ টাকা। এতে দেখা গেছে প্রতিটি ডিমের উৎপাদন মূল্য পড়ে ৭ টাকা।
জানা গেছে, দেশের প্রায় সব প্রান্তিক খামারিই বিভিন্ন এনজিও এবং স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। কিন্তু টানা লোকসানের মুখে তারা আর ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না। ব্যবসায়ীদের দাবি, এতে লোকসানের বোঝা ভারী হওয়ার পাশাপাশি বিপাকে পড়ছেন তারা। তাই এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে, কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি তাদের। বাজারে মিলছে না ন্যায্য দাম, হু হু করে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। তাই ব্যবসায়ীদের ব্যতিক্রমী এই আন্দোলন।
একই কায়দায় রাজপথে গাজীপুরের পোল্ট্রি খামারিরাও। তাদের প্রতিবাদের ভাষাও একই। খামারিরা বলছেন, মুরগির বাচ্চা কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। লাগামহীন খাবারের দরও। এরপরও কোন রকমে এতোদিন ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছিলেন তারা। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ব্যবসা পরিধি বাড়ানোয় কমে গেছে ডিমের দাম। তাই ভারী হচ্ছে লোকসানের বোঝা।
ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা চান ব্যবসায়ী নেতারা। এ নিয়ে আলোচনা চলছে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সাথে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পোল্ট্রি খামারীরা।
দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষ চাহিদার ৪৫ শতাংশ এখন পোলট্রি খাতনির্ভর। ৪৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার এ খাতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। খাতটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের। তবে এত কিছু অর্জনের পরও নানা প্রতিবন্ধকতায় কমছে পোলট্রি উৎপাদন প্রবৃদ্ধি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং এন্ড মনিটরিং ইউনিটের (এফপিএমইউ) প্রস্তুতকৃত ‘ন্যাশনাল ফুড পলিসি প্ল্যান অব একশন এন্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান: মনিটরিং রিপোর্ট ২০১৬’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত দুই অর্থবছরে পোলট্রি মাংস উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ খাতে ২৫ কোটি ৫৩ লাখ পোলট্রি মুরগি উৎপাদন হয়, যা আগের বছরের চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি ছিল। পরের অর্থবছরে (২০১৪-১৫) সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ কোটি ১৮ লাখ। এ সময় প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। যদিও ২০০৭-০৮ অর্থবছরের পরের চার অর্থবছরে এ খাতে গড়ে প্রতি বছর ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পোলট্রি খাতের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমার পেছনে দুই দফা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিনিয়োগ সংকট সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে দুই দফা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক খামারই উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। উৎপাদন সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হয়েছে ছোট খামার বন্ধের কারণে। পাশাপাশি বার্ডফ্লুসহ নানাবিধ রোগের প্রভাব, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা ও খাতটি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে চাহিদা সংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে। বড় খামারগুলো উৎপাদন ধরে রাখতে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে সমর্থ্য হলেও গোটা খাতের সংকট কাটাতে যথেষ্ট নয়।
জানা গেছে, উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ডিম ও মাংসগ্রহণে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। জাপানের মানুষ বছরে গড়ে ৬০০টি ডিম খায়, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় ৫০টি। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ যেখানে বছরে গড়ে প্রায় ৫০ দশমিক ১ কেজি মুরগির মাংস খায়, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় মাত্র ৩ দশমিক ৬৩ কেজি।
ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, ছোটবড় হ্যাচারি থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫৫-৬০ লাখ ব্রয়লার ও চার-পাঁচ লাখ লেয়ার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয়। আর দেশে প্রতিদিন গড়ে পোলট্রি মাংস উৎপাদন হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টন। বিপিআইসিসি ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৬ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৮০ হাজার পোলট্রি খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রতি বছর গড়ে ২৫ লাখ টন ফিডের প্রয়োজন, যা ছোটবড় প্রায় ২০০ ফিড মিল সরবরাহ করে। পোলট্রি খাতে ৬০-৭০ শতাংশই খরচ হয় ফিড বা খাদ্য বাবদ। আবার সে খাদ্য তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৫৫-৬৫ শতাংশই ভুট্টার ব্যবহার হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই দেশে ব্যাপকভাবে বেড়েছে ভুট্টার আবাদ। এছাড়া পোলট্রি খাতের ওপর দেশের নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত আড়াইশ ওষুধ কোম্পানিও নির্ভরশীল, যার বার্ষিক আয় প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। ফলে পোলট্রি খাতের সংকোচনের নেতিবাচক প্রভাব এসব খাতের ওপরও পড়বে।
ওয়ার্ল্ড’স পোলট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন (ওয়াপসা) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ পোলট্রি খামারই ছোট পরিসরের। এসব খামারের প্রতিটির গড় মুরগি উৎপাদনক্ষমতা তিন হাজার থেকে সাত হাজার। ফলে ছোট খামার বন্ধ হয়ে যাওয়াটা সামগ্রিকভাবে বেশি সংখ্যক পরিবারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ওয়াপসা ও সিপিডির তথ্যমতে, প্রতি বছর দেশে গড়ে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বাড়ছে। এ হিসাবে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে দৈনিক প্রায় সাড়ে চার কোটি ডিম ও প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টন মুরগির মাংসের প্রয়োজন হবে। মাংস ও মুরগির এ চাহিদা মেটাতে পাঁচ বছরে মধ্যে এ খাতে বাড়তি ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন।
পোলট্রি খাতের ছয়টি সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ কো-অর্ডিনেশন কমিটির (বিপিআইসিসি) আহ্বায়ক মসিউর রহমান বলেন, খাতটির উন্নয়নে উদ্যোক্তা সহায়ক স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। সার্বিক কৃষি খাতের অংশ হিসেবে পোলট্রি খাতে যথাসময়ে স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ, বিপণন সুবিধা প্রদান, রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান করতে হবে। দেশের পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিম ও মাংস আমদানিকে উৎ্সাহ প্রদানের পরিবর্তে দেশে উৎপাদন বাড়ানোয় বেশি নজর দিতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের সিংহভাগ পোলট্রি খামার ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে উঠেছে। এ অবস্থায় বিদেশীদের বিনিয়োগের জন্য টাকা জোগাড় করা সহজ, যা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ কঠিন। উন্নত প্রযুক্তিও তাদের জন্য সহজলভ্য। এক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতার কারণে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ব্যবসা হারাতে বাধ্য হচ্ছেন। এজন্য নীতিমালায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/283181-