৫ জানুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৩৭

এটিকে প্রকৃত অর্থে নির্বাচন বলা যায় না : বিবিসির প্রতিবেদন

 

বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন বলছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কৃত্রিম আবহ তৈরি করা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রকৃত অর্থে নির্বাচন বলা যায় না এবং নির্বাচনটি আইনগতভাবে বৈধতা পেলেও এই নির্বাচন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে তারা মনে করে না।

নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা এই সংস্থাটি এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তৃতায় বলেছে, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা নেই বরং যারা অংশ নিচ্ছে তারা প্রায় সকলেই পরস্পরের মিত্র। নির্বাচনটির অভিনবত্ব হলো আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থী।’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুজন সদস্য দিলীপ কুমার সরকার। এতে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এবারের নির্বাচনের হলফনামা অনুসারে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আয় বৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

তবে সংসদ নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে উল্লেখ করে এ নির্বাচনের ভোট কেন্দ্রে যেতে কিংবা না-যেতে ভোটারদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

একইসাথে তারা রাজনৈতিক সঙ্কট কাটাতে নির্বাচনের পর দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ আয়োজনের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করেছে।

উল্লেখ্য, আগামী রোববার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো এ নির্বাচন বর্জন করছে।

তারা ইতোমধ্যেই ভোটারদের এ নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট বিতরণসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে।

নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়ন
সুজনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে একটি নির্বাচনের বড় বৈশিষ্ট্য থাকে ফলাফলের অনিশ্চয়তা, সর্বজনীনতা এবং নির্বাচনী আইনের অনুসরণ। কিন্তু এবারের নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই বরং আগেই এটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী আইনের যথাযথ অনুসরণ না হওয়ার প্রমাণ হলো ব্যাপকভাবে আচরণবিধি ভঙ্গ। এই নির্বাচনে প্রকৃত অর্থে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী এবং তাদের জোট সঙ্গীদের সাথে স্বতন্ত্রদের। এ নির্বাচনে যারা অংশ নিচ্ছে তারা সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং প্রায় সকলেই পরস্পরের মিত্র।’

এতে বলা হয় এই নির্বাচনের অভিনবত্ব হলো আওয়ামী স্বতন্ত্র বা আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী, যার মধ্যে সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগেরই প্রভাবশালী নেতারা আছেন।

তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচনে যিনিই জয়লাভ করবেন, তিনিই সরকারের লোক। এখানে কৃত্রিমভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি করা হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় এটিকে প্রকৃত অর্থে নির্বাচন বলা যায় না।’

সুজন বলছে ভোটার অংশগ্রহণ বৃদ্ধির যে কৌশল এই নির্বাচনে নেয়া হয়েছে তাতে সারাদেশে সংঘর্ষ-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে এবং নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের মহোৎসব চলছে।

উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট এক হাজার ৯৪৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

নির্বাচনের পর সংলাপসহ নানা সুপারিশ
সুজন বলছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন হলেও এই নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ হচ্ছে না।

কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে এবং নির্বাচন বর্জনকারীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান জানানোর কারণে একটি পাল্টাপাল্টি অবস্থা তৈরি হয়েছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে আছে-

* নির্বাচনের পর দ্রুত সরকারের উদ্যোগে সব দলের মধ্যে সংলাপ
* রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে সমঝোতায় আসা
* নির্বাচনের গেজেট প্রকাশের আগেই হলফনামায় দেয়া তথ্য যাচাই করা এবং ভুল তথ্য দানকারীদের ফল বাতিল করা
* নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার
* সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করা

প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে সুজন বলেছে এ নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের মধ্যে ৬৩২ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর, ৫১৪ জন স্নাতক, ২৫৭ জনের এইচএসসি ও ১৫০ জনের এসএসসি।

প্রার্থীদের মধ্যে এসএসসির নিচে আছেন ১২৩ জন আর নিরক্ষর ও স্বশিক্ষিত আছেন ২৩৮ জন। আর ৩১ জন শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্যই দেননি।

তবে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের দেয়া তথ্যের সাথে তুলনা করে প্রতিষ্ঠানটি বলছে এবারের প্রার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত উভয় হারই হ্রাস পেয়েছে।

প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের আয় সম্পর্কিত তথ্য
প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে সুজন বলছে প্রার্থীদের মধ্যে ১৭০ জনের আয় বছরে এক কোটি টাকার বেশি আর ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা আয় করেন ১০৩ জন প্রার্থী।

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় যে কোটি টাকা বেশি আয়কারী প্রার্থী আওয়ামী লীগে বেশি। আর সবচেয়ে কম জাতীয় পার্টিতে।’

এছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় এবারের নির্বাচনের কোটি টাকা বেশি আয়কারীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।

তিনি বলেন, ‘বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় নির্বাচনী রাজনীতিতে ক্রমশ স্বল্প আয়ের মানুষের অংশগ্রহণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং অধিক আয়ের প্রার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

এছাড়া এবারের প্রার্থীদের মধ্যে ২০৪ জন ঋণগ্রহীতা এবং এর মধ্যে কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন ৮৬ জন। অন্যদিকে এবারের প্রার্থীদের মধ্যে আয়কর দিয়েছেন ৯১৫ জন এবং এর মধ্যে ৩১৬ জন কর দিয়েছেন পাঁচ হাজার টাকার নিচে।

সূত্র : বিবিসি

https://dailyinqilab.com/national/news/629105