১০ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:১৪

টেলিটকেরও পরিচালক তিনি

পিএসসির সদস্য কামাল উদ্দিন শপথ ভেঙেছেন

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য কামাল উদ্দিন আহমেদ একই সঙ্গে মুঠোফোন অপারেটর টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। সাংবিধানিক পদের শপথ ভঙ্গ করেই তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন।

আর নিজের সাংবিধানিক পদের পরিচয় গোপন করতে কামাল উদ্দিন আহমেদ বিশেষ কৌশলেরও আশ্রয় নিয়েছেন। টেলিটকের কোনো নথিতে কামাল উদ্দিন আহমেদ নিজের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় দিচ্ছেন না; বরং সেখানে রয়েছে বেইলি রোডে সরকারি বাসার ঠিকানা।

অথচ পিএসসি কার্যালয়ে কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে টেলিটকের সাবেক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা দেখা করেন। এমনকি পিএসসির সদস্য থাকা অবস্থায় তিনি টেলিটকের নিয়োগ, প্রচারসহ বিভিন্ন কমিটি-উপকমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বে থেকেছেন।

পিএসসি প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য উপযুক্ত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নির্বাচন করার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং এর চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেন। সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ ও ৪ উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তিরা মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানি, সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে থাকতে পারবেন না। সরকারের মালিকানাধীন হলেও টেলিটক শতভাগ বাণিজ্যিক কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পিএসসির মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে টেলিটকের মতো একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে থাকার মধ্য দিয়ে কামাল উদ্দিন আহমেদ শপথ ভঙ্গ করেছেন।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এ নিয়ে কামাল উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য নেওয়ার জন্য পিএসসি কার্যালয়ে এর আগে মোট চারবার যাওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবারই তিনি ব্যস্ত, বৈঠক করছেন এমনটা জানানো হয়। এর মধ্যে গত সোমবার পিএসসির কার্যালয়ে আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর আবারও কার্যালয় থেকে জানানো হয়, তিনি গুরুত্বপূর্ণ সভায় আছেন। তবে বিকেল চারটার দিকে টেলিটকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আহমেদকে বের হতে দেখা যায়।
এ ব্যাপারে গিয়াস উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগত কাজে ও গল্পগুজব করতে কামাল উদ্দিন আহমেদের কাছে গিয়েছিলেন।
এরপর গতকাল মঙ্গলবার পঞ্চম দিনে গিয়ে অবশেষে কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে প্রতিবেদকদের সাক্ষাতের সুযোগ হয়। বিকেল চারটায় তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে চোখে পড়ে চাকরিপ্রার্থী একাধিক ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনদের উপস্থিতি। প্রতিবেদকদের সামনেই চাকরির সুপারিশের কাগজ নিয়ে আসা এক ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, কাগজ দিতে হবে না, এসব বিষয় এমনিতেই হয়ে যায়। আরেক ব্যক্তি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে চাকরির সুপারিশের কথা বলেন। তিনি পরে হবে বলে তাঁকে বিদায় করেন।
টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে কাগজপত্রে নাম থাকা এবং সভায় অংশ নেওয়ার এই প্রশ্ন করলে কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ওইটা কে বা কারা সুযোগ বুঝে আমার নাম দিচ্ছে, তা আমি জানি না। আমি তো আমার লেভেলে আছি। আমি কী ছিলাম বা ছিলাম না তা না খুঁজে, ওখানে কী দুর্নীতি হয়েছে তা খোঁজেন। আর প্রতি সপ্তাহে আমার কাছে আইসেন। আপনাদের কোনো ছোট ভাই, আত্মীয় থাকলে নাম নিয়া আইসেন—ব্যবস্থা করে দেব।’
তবে পিএসসির সদস্য কামাল উদ্দিনের কাছে এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে টেলিটকের অফিশিয়াল কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আগে আমি আইসিটি মন্ত্রণালয়ে ছিলাম। টেলিটকের বোর্ডে ছিলাম। চেনাজানা সবার কাছেই আমি যাই। আমি মিশুক লোক।’
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পিএসসির সদস্য হিসেবে কামাল উদ্দিন আহমেদকে নিয়োগ দেয় সরকার। এর আগে তিনি ২০১৫ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ থেকে অবসরে যান। আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে থাকার সময়ে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হন তিনি।
এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব এবং টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি। টেলিটকের বোর্ডের প্রথম সভায় বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। এটা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এটা নিয়ে আপনাদের চিন্তা করার কিছু নেই।’
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরপরই কামাল উদ্দিন আহমেদের টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়ার কথা। এমনকি এই পদ থাকারও কথা নয়। কিন্তু সেটা না করে এক বছরের বেশি সময় ধরে পরিচালক পদে রয়েছেন কামাল উদ্দিন আহমেদ। সর্বশেষ গত ৯ এপ্রিল টেলিটকের ১৬৬তম পর্ষদ সভায়ও তিনি অংশ নেন। ওই বৈঠকে টেলিটকের প্রচারণাবিষয়ক একটি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে তাঁকে। এর আগে তিনি টেলিটকের নিয়োগ কমিটি ছাড়াও বেশ কয়েকটি উপকমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি পরিচালনা পর্ষদের সভায় অংশ নেওয়ার জন্য একজন পরিচালক ছয় হাজার টাকা করে সম্মানী পান।
সাংবিধানিক পদে থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে কীভাবে আছেন জানতে চাইলে কামাল উদ্দিন প্রথম আলোর প্রতিবেদকদের বলেন, ‘বাদ দেন এসব।’
শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ রয়েছে, পিএসসি কার্যালয়ে বসেই টেলিটকের সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেন কামাল উদ্দিন আহমেদ। এ ক্ষেত্রে ২০১৬ সালের নভেম্বরে বিদায় নেওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে কামাল উদ্দিনের বিশেষ সখ্যের কথাও বলেন টেলিটকের কর্মকর্তারা। গিয়াস উদ্দিন বর্তমানে টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রকৌশল) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
টেলিটকের দুর্নীতি ও গিয়াস উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইলে কামাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনি সামনের সপ্তাহে আমার অফিস আইসেন, গিয়াসের সঙ্গে বসাইয়া দিমুনে। আর এই সব নিয়া চিন্তা কইরেন না।’
এসব বিষয়ে টেলিটকের বর্তমান এমডি কাজী মো. গোলাম কুদ্দুসের কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পিএসসির সদস্য হওয়ার পর টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বৈঠকে অংশ নিয়েছেন, সেটার উল্লেখ নেই বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে। টেলিটকের ১৬৬তম সভার কার্যবিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, অন্য সব পরিচালকের ক্ষেত্রে তিনি কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কামাল উদ্দিন আহমেদের ক্ষেত্রে শুধু তাঁর বেইলি রোডের সরকারি বাসভবনের ঠিকানা উল্লেখ করা আছে কার্যবিবরণীতে।
অথচ পিএসসির সদস্য হওয়ার আগে তিনি যখন আইসিটি বিভাগে অতিরিক্ত সচিব ছিলেন, সেটি আগের পরিচালনা পর্ষদের কার্যবিবরণীতে উল্লেখ ছিল। টেলিটকের ওয়েবসাইটে পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের পরিচিতি তালিকায় কামাল উদ্দিনকে আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বলা হয়েছে। অথচ ১৮ মাসের বেশি সময় তিনি এই দায়িত্বে নেই।
গত ফেব্রুয়ারিতে টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার। এর আগ পর্যন্ত পদাধিকারবলে টেলিটকের বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী। ফেব্রুয়ারিতে সেই পরিবর্তনের বিষয়টি ওয়েবসাইটে সংশোধন করা হলেও এক বছরের বেশি সময় আগে অবসরে যাওয়া কামাল উদ্দিনের পরিচয় অতিরিক্ত সচিবই রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সাংবিধানিক একটি পদে থেকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকা অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য। পিএসসির মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিতে এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সরকারের দুজন মন্ত্রী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকার কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1175476/