৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১:০৮

উড়োজাহাজের জ্বালানি সঙ্কট টিকেটের দাম বাড়ার শঙ্কা

 

দেশে উড়োজাহাজের জ্বালানি জেট এ-১ ফুয়েলের মজুদ যে কোন সময় শেষ হয়ে যাবে। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে দেশের বিমান চলাচল ব্যাহত হতে পারে। এদিকে জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বিমানের টিকিটের দাম বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। উড়োজাহাজের জ্বালানি জেট এ-১ ফুয়েলের মজুদ দেশে যা আছে, তা আজ শনিবার শেষ হয়ে যাবে। গতকাল শুক্রবারের মধ্যে জেট ফুয়েল নিয়ে জাহাজ না এলে উড়োজাহাজে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোনো উপায়ই থাকবে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)। মূলত বিদেশী প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় সরবরাহ কমানো এবং শিপমেন্ট পিছিয়ে দেয়ার পর বাতিলের ঘটনায় এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। যদিও এ নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)।
জেট এ-১ ফুয়েল সরবরাহকারী সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের জেট এ-১ ফুয়েল ১ জানুয়ারি পর্যন্ত মজুদ আছে। আগামী ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে জেট এ-১ ফুয়েলবাহী জাহাজ। কাজেই জ্বালানি সঙ্কট হবে না। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির পর পদ্মা অয়েল কম্পানির মাধ্যমে জেট ফুয়েল বিপণন করে বিপিসি। জেট ফুয়েলের মজুদ শেষ হয়ে আসার বিষয়ে বিপিসির বাণিজ্য ও অপারেশন বিভাগকে ২৪ ডিসেম্বর চিঠি দিয়েছে পদ্মা অয়েল কম্পানি। পদ্মা অয়েল কম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক (পরিচালন) মো. আসিফ মালেক স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে বিক্রয়যোগ্য জেট এ-১ ফুয়েল মজুদ রয়েছে ৯ হাজার ২১ টন। তা থেকে দৈনিক গড় বিক্রির পরিমাণ এক হাজার ৫০৮ টন ধরলে এই জ্বালানি আর মাত্র ছয় দিন বিক্রি করা সম্ভব। অর্থাৎ বর্তমান মজুদ থেকে জেট এ-১ ফুয়েল ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রি করা যাবে। এমন পরিস্থিতিতে চিঠিতে দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জেট এ-১-এর বিক্রয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় ২৯ ডিসেম্বরের পর ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি মাসে উল্লিখিত পরিমাণ জ্বালানি আমদানির অনুরোধ জানানো হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিপিসির কাছে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী ছয়টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পাওনা রয়েছে ২৯ কোটি ৫৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া থাকা সেই অর্থ পরিশোধে তাগিদ দিলেও দেশে ডলার সঙ্কট থাকায় বিপিসি দিতে পারছে না। তথ্যমতে বিদেশী কোম্পানির কাছে বকেয়া পাওনা রয়েছে- সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়া ও চীনা প্রতিষ্ঠান জায়ান্ট ইউনিপেক বিপিসির কাছে ৪ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার, ভিটল ১০ কোটি ৫ লাখ ৮ হাজার, এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (ইএনওসি) ১ কোটি ৪৪ লাখ, পিটি বুমি শিয়াক পুসাকো (বিএসপি) ৭ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার, পিটিএলসিএল ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার ও পেট্রো চায়না পাবে ১ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার ডলার। জ্বালানি সরবরাহের পরও দীর্ঘদিন বকেয়া পরিশোধ না করায় নতুন করে ঋণপত্র খুলতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক জনতা, অগ্রণী ও সোনালী। এর মধ্যে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো জনতা ব্যাংকের কাছে পাবে ৭ কোটি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার, অগ্রণী ব্যাংকের কাছে ১২ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ও সোনালী ব্যাংকের কাছে ৯ কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার। বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে প্রতিদিন ৬-৭ কোটি ডলার বকেয়া পরিশোধ ছাড়া অন্য উপায় নেই বলে জানিয়েছে বিপিসি।

জ্বালানিসচিবকে গত ১১ ডিসেম্বর দেওয়া জরুরি চিঠিতে বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওয়ার বিস্তারিত হিসাব তুলে ধরেন। সঙ্কট উত্তরণে প্রতিদিন ছয়-সাত কোটি ডলার বকেয়া পরিশোধ ছাড়া অন্য উপায় নেই বলে জানিয়েছে বিপিসি।
বিপিসি ও চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ বার্থিং তথ্যে দেখা যায়, গত ২৩ ডিসেম্বর হংকং থেকে ‘কুই চি’ নামের জাহাজ সাড়ে ৯ হাজার টন জেট ফুয়েল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে এসেছে। জাহাজটিকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসার কথা ছিল গতকাল ২৯ ডিসেম্বর সকাল ১১ টায়। তবে শেষ খবর পর্যন্ত বন্দরে ভেড়েনি জাহাজ। আরেকটি জাহাজ ‘নর্থ মাজেস্টিক’ সিঙ্গাপুর থেকে জেট এ-১ ফুয়েল নিয়ে আসবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই বন্দরে পৌঁছার অনুরোধ জানিয়ে জাহাজগুলোর ক্যাপ্টেনকে ই-মেইলে বার্তা পাঠিয়েছে বিপিসি। তবে এসব ফুয়েল বন্দর থেকে খালাস হতে কমপক্ষে আরো দুই থেকে তিন দিন সময় লাগবে।

আমদানির পর পদ্মা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে জেট ফুয়েল বিপণন করে বিপিসি। জেট ফুয়েলের মজুদ শেষ হয়ে আসার বিষয়ে বিপণন সংস্থাটি তাদের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। বিপিসির বাণিজ্য ও অপারেশন বিভাগকে ২৪ ডিসেম্বর চিঠি দিয়ে তারা জানিয়েছে, দ্রুত আমদানি না হলে ২৯ ডিসেম্বরের পর দেশ জেট ফুয়েলশূন্য হয়ে পড়বে। পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক (পরিচালন) মো. আসিফ মালেক স্বাক্ষরিত চিঠিতে আরও বলা হয়, নভেম্বরে পদ্মা জেট এ-১ বিক্রি করেছে ৪৫ হাজার ২৩৫ টন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেট ফুয়েলের মজুদ ছিল ১৭ হাজার ৭০০ টন। প্রতিদিন চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৫০৮ টনের মতো। সে হিসাবে আগামীকালের মধ্যেই মজুদ পৌঁছবে শূন্যের কোটায় (ডেডস্টক অর্থাৎ ট্যাংকে রাখা জরুরি সর্বনিম্ন জ্বালানি বাদে)। বিপিসি অবশ্য বলছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিপেকের একটি চালান শুক্রবার দেশে পৌঁছার কথা রয়েছে। ওই জ্বালানি ৩০ ডিসেম্বর বিমানবন্দরগুলোয় সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তবে চালানটি পৌঁছতে একদিন বিলম্ব করলেও দেশে উড়োজাহাজে জ্বালানি দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে বিপিসিকে।

এ বিষয়ে বিপিসি’র পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়–য়া বলেন, জ্বালানি আমদানি, মজুদ এসব বিষয় অপারেশন বিভাগের কাজ। আমার কাছে জেট ফুয়েল ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। এখন পর্যন্ত মজুদ আছে, তবে সেটি পর্যাপ্ত কিনা বলতে পারব না।
তবে প্রতিষ্ঠানটির বিপণন ও অপারেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের কাছে যে পরিমাণ জেট এ-১ ফুয়েল রয়েছে তা ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ২৯ ডিসেম্বর দেশে জাহাজ পৌঁছলে পদ্মা অয়েলের ডিপোয় জ্বালানি আসতে আরো কয়েক দিন সময় লেগে যেতে পারে। তাতে দেশে জেট ফুয়েলের সরবরাহ চেইন বজায় রাখার কোনো সুযোগই থাকছে না।

https://dailyinqilab.com/national/article/627529