৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১:০২

পশ্চিমারা প্রতিযোগিতাহীন দেখছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে চলছে নানা ধরনের বিশ্লেষণ। ঢাকায় কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকরাও এই নির্বাচনের দিকে রাখছেন তীক্ষè নজর। পশ্চিমা কিছু কূটনীতিকের ও রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব রয়েছে এবং ভোটারদের হাতে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার প্রকৃত বিকল্প নেই। এটা একটি একতরফা ডামি প্রার্থীর নির্বাচন নির্বাচন খেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ভোটারদের কাছে তেমন বিকল্প প্রার্থী নেই; ফলে আগামী ৭ জানুয়ারির ভোটে জয় হবে আওয়ামী লীগের। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েই তার অবস্থান জানিয়েছে। তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করলে ভিসা না দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে ওয়াশিংটন। এদিকে গতকাল শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে সংস্থা দুটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে আসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে জানতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা। সংস্থা দুটি হলো- ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউট (এনডিআই)। একইসঙ্গে তারা নির্বাচনকালীন সহিংসতার পাশাপাশি মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা কমিশনকে জানিয়েছে। এরপর রুদ্ধদ্বার আলোচনা সভা শুরু হয়।

এদিকে বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তোড়জোড়, অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সাথে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস এবং জাতীয় পার্টি-সহ ক্ষমতাসীন দলের মিত্রদের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও নির্বাচনটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা কতটা পাবে, তা নিয়ে প্রবল সংশয় রয়েই গেছে। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমানও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্ভাব্য পদক্ষেপের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন ভালো নির্বাচন না হলে ‘দেশের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না’।

ঢাকার কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়ে বছরের প্রথম থেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিরা। তারা বৈঠক করেন, সরকার ও বিরোধীপক্ষের নেতাদের সাথে। তবে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসেনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল দল। ঢাকায় কাজ করছে তাদের কারিগরি দল। ভোটের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তারা প্রতিবেদন বানিয়েছেন। এরই মধ্যে ওই প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পশ্চিমা প্রভাবশালী একটি দেশের কূটনীতিক নাম না প্রকাশের শর্তে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে নির্বাচনে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা জোটগত দলগুলো নির্বাচন বয়কট করায় ভোটারদের হাতে প্রকৃত বিকল্প নেই।

এ নির্বাচন ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন দূতাবাস। সেই সঙ্গে সংঘাত-সহিংসতায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার কথা তারা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। সব রাজনৈতিক দলকে রাজি করিয়ে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে না পারায় আক্ষেপ রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে। ইইউভুক্ত দেশের এক কূটনীতিক ঢাকার একটি গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনীতিতে বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদ- সবার মেনে চলা উচিত। এগুলো দেশের উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রাখতে সহায়তা করে। আর বাংলাদেশকে তা ইইউর জিএসপি প্লাস পেতে সহায়তা করবে। কারণ ইইউর জিএসপি প্লাসের অন্যতম শর্ত হলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন। ওই কূটনীতিক জানান, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইইউর একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ সফর করছে। তারা তাদের প্রতিবেদন দেবে ভোটের কয়েক সপ্তাহ পর।

কূটনীতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে, তাকে ক্ষমতাসীন দলের যোগ্য প্রার্থী বাছাই বললে খুব একটা ভুল হবে না। কারণ পুরো বিষয়টি যেভাবে সামনে এসেছে, তাতে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগই। তাদের একজন নৌকা প্রতীক পেয়েছেন, আরেকজন পাননি। এদিকে রাশিয়া, ভারত ও চীন বলেছে, নির্বাচন একেবারেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে; বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট হস্তক্ষেপ করছে বলে তারা মনে করে। এ ছাড়া বাংলাদেশ নিয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, জাপানসহ প্রতিটি দেশের রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশলগত লক্ষ্য ও অগ্রাধিকার। বিদেশি কূটনীতিকরা বলছেন, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে চাপে রাখার পরিবর্তে তারা বাংলাদেশকে সহযোগিতার  মানসিকতায় রয়েছেন। ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যে জিএসপি সুবিধা ২০৩২ পর্যন্ত বহাল রাখা ও শ্রম খাতের অগ্রগতিতে সহযোগিতা করার ঘটনা তারই নজির। ঢাকায় ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি গণমাধ্যমকে বলেন, জিএসপির মতো বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়েও ইইউর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ইইউ নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই গ্রহণ করে, তবে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনাও করে।

সাবেক কূটনৈতিক হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, প্রধান প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল যারা আছেন তারা সেখানে অংশগ্রহণ করলে সেখানে একটা পছন্দের বিষয় থাকে। আর সেটা যদি না থাকে তাহলে তো সিদ্ধান্ত দেয়ার সুযোগ থাকে না। যদি সেটা হয় তাহলে সেটা ইতিবাচক ফলাফল আনে এবং প্রভাব তৈরি করে। আমরা দেখেছি ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বের অনেকে সমালোচনা করেছেন। আর যদি তেমন ঘটনা ফের না ঘটে তাহলে নিন্দিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনটি যত ভালোই হোক সবাই জানে কারা ক্ষমতায় আসবে এবং সে কারণে পশ্চিমারা যে মানের নির্বাচন চেয়েছিলো সেই প্রত্যাশা তাদের পূরণ হয়ে গেছে বলে মনে হয় না। পশ্চিমারা আগেই বলেছে তারা কেমন নির্বাচন চায়। সেটি না হলে কী ধরণের ব্যবস্থা হতে পারে তার ইঙ্গিতও তারা আগেই দিয়েছে। তাদের অনেক কংগ্রেসম্যান স্যাংশনের কথা বলেছেন। সে কারণে নির্বাচন নিয়ে তাদের আপত্তি থেকেই গেলে নানা আশঙ্কা থেকেই যায়।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে নির্বাচনের পর মার্কিন ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, নির্বাচন পরবর্তী যেকোনো বৈশ্বিক চাপ কূটনৈতিকভাবে সামাল দেয়াই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন, তবে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষত: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা, তা নিয়ে এখনই ভাবছে না সরকার। সচিব বলেন, আপাতত লক্ষ্য সুষ্ঠু ভোট। এ নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অঙ্গীকার রয়েছে। এখন পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ। কাক্সিক্ষত টার্ন ওভার হবে বলেই আশা করছি। জনগণের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার পর নিষেধাজ্ঞা বা অন্য যাই আসুক আমরা আশা করি তা যৌক্তিকভাবেই মোকাবিলা করতে পারবো।

 

https://www.dailysangram.info/post/544647