১০ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৮

মানব পাচার ও টাকা পাচার

সহজ কথা

|| আলফাজ আনাম ||


বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা দাবি করছেন দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কাছাকাছি চলে গেছে বাংলাদেশ। বেশ কিছু বড় আকারের উন্নয়ন প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের তাগিদ দিচ্ছেন সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে। স্বীকার করতেই হবে দেশে, বিশেষ করে রাজধানীতে বড় ধরনের বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু যেমন আছে তেমনি মেট্রোরেল ও উড়াল সড়কের মতো প্রকল্পও রয়েছে। এ কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা মানে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন নয়। একটি দেশের সার্বিক উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের মানুষের জীবনমানের কতটা উন্নতি হয়েছে তার ওপর।
বাস্তবতা হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। নতুন করে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে। ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে নতুন কোনো শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না। নতুন শিল্পকারখানা গড়ে না উঠলে তরুণদের চাকরি হবে না। শিল্পকারখানা গড়ে না উঠার মানে হচ্ছে দেশের বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে না। এমন পরিস্থিতিতে তরুণদের বিরাট একটি অংশ এখন হতাশায় নিমজ্জিত। অপর দিকে দেশে একটি লুটেরা শ্রেণী গড়ে উঠছে। যারা সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ও ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে সম্পদের মালিক বনে গেছেন।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিনির্ভর বিপরীতমুখী দু’টি খবর প্রকাশ হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক দিকের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে। লন্ডনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার এক খবরে বাংলাদেশী নাগরিকরা কিভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাচ্ছে তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। সিরিয়ার যুদ্ধের কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ ইউরোপে চলে গেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বহু দূরের দেশ বাংলাদেশের নাগরিকরা ইউরোপে ঢুকে পড়ছে। সিরিয়া, লিবিয়া বা তিউনিসিয়ার নাগরিকদের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকরা অনেকটা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও দালালদের হাতে সর্বস্ব তুলে দিয়ে কিভাবে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। Bangladesh is now the single biggest country of origin for refugees on boats as new route to Europe emerges
শিরোনামে এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা বাংলাদেশীরা সাহায্যকর্মীদের জানিয়েছেন, ইউরোপে অভিবাসনের পথে প্রথমে তাদের ঢাকা থেকে দুবাই বা তুরস্কে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। চলমান সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার সুযোগে মানব পাচারকারীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে লিবিয়ায়। এখান থেকেই ইউরোপের উদ্দেশে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া শুরু করেন অভিবাসন প্রত্যাশীরা। এ জন্য তাদের জনপ্রতি ব্যয় করতে হয়েছে ১০ হাজার ডলারেরও বেশি।
গত বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উপকূলে এসে নেমেছিলেন মাত্র একজন বাংলাদেশী। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এসে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮০০’রও বেশি। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের উপকূলগামী অভিবাসীদের সবচেয়ে বড় সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকেরা।
আইওএমের মুখপাত্র ফাভিও ডি জিয়াকোমো ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, ‘মূলত যে বিষয়টিতে আমরা এখন সত্যিকারের পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি তা হলো, অভিবাসন প্রত্যাশীদের মূল জাতীয়তা। এসব অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যাগরিষ্ঠই আসছেন বাংলাদেশ থেকে। গত বছরের শুরু থেকে মার্চ পর্যন্ত ইতালিতে পা রাখা বাংলাদেশী শরণার্থী ছিলেন মাত্র একজন। সেখান থেকে এ বছরের একই সময়সীমায় বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮৩১-এ। ’
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের লিবিয়াবিষয়ক গবেষক হানান সালেহ বলেন, আমার জানামতে, দুবাই থেকে ত্রিপোলি (লিবিয়ার রাজধানী) বা লিবিয়ার অন্য কোথাও সরাসরি কোনো উড়োজাহাজের ফাইট নেই। অধিকাংশ বিদেশী সম্ভবত প্রতিবেশী তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস থেকে ফাইট পরিবর্তন করে ত্রিপোলির মিতিগা বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করেন। আমাদের কাছে খবর এসেছে যে, কোনো কোনো েেত্র এসব বিদেশী নাগরিকের কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি তাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার একটি কৌশল হতে পারে।’
উপসাগরীয় দেশগুলোর পাশাপাশি লিবিয়ায়ও জোর করে কাজ করানোর রেওয়াজ আছে। এসব জায়গায় মানব পাচারকারীরা প্রায়ই অভিবাসীদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, জোর করে কাজ করতে বাধ্যকরা বা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করছে। এসব অভিবাসন প্রত্যাশীর কেউ কেউ লিবিয়ায় চার বছর পর্যন্ত থেকে গেছেন। আবার কেউ কেউ আছেন, যারা কয়েক মাস থেকেই এখান থেকে সরাসরি ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
বর্তমানে উত্তর আফ্রিকা থেকে ইতালি পর্যন্ত রুটটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্রপথগুলোর অন্যতম বলে ধরে নেয়া হয়। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত এখানে ডুবে গিয়ে, মাত্রাতিরিক্ত যাত্রীবাহী নৌকায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এবং হাইপোথারমিয়ায় (শরীরের তাপমাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমে যাওয়া) আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১১০০’র বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী।
ইনডিপেনডেন্টের এই রিপোর্ট থেকে আমরা জানছি বাংলাদেশী নাগরিকেরা কিভাবে শুধু কাজের আশায়, ভালো জীবনযাপনের জন্য, জীবন বিপন্ন করে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। এ জন্য তারা ব্যয় করছে ১০ হাজার ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় ৮ লাখ টাকার বেশি। নিশ্চয়ই গ্রামের এই তরুণরা জমি-জিরেত বা ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। প্রশ্ন হচ্ছে দেশে যদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকত তাহলে কি এই তরুণরা এভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশ যাওয়ার ঝুঁকি নিতো? এই প্রশ্নের উত্তর এখন ক্ষমতাসীনদের দিতে হবে।
সিরিয়া ও লিবিয়ায় যুদ্ধ চলছে। সেখানকার মানুষ শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করছে। সমুদ্র ভাসমান শিশু আইলান কুর্দির ছবি দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। বাংলাদেশে তো কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি নেই। তারপরও কেন এই তরুণরা এভাবে বিদেশ যাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে? এভাবে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা আর আত্মাহুতি দেয়ার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। বাস্তবতা হচ্ছে তা বুঝেও তরুণরা চাকরির আশায় ছুটছেন।
বাংলাদেশের তরুণদের ঝুঁকিপূর্ণ বিদেশ যাত্রার খবরের সাথে একই সময়ে আরেকটি খবর এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে। এতে বলা হয়েছে, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে তুলনামূলক বেশি অর্থ পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। জিএফআইয়ের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বা প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে দুটি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। একই সময়ে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের গড়ে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রায় দুই অর্থবছরের বাজেট তৈরি করতে পারতেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রতি বছর এই যে বিপুলসংখ্যক টাকা পাচার হচ্ছে তার সাথে কারা জড়িত? বিপুল অর্থবিত্তের মালিকরা ছাড়া তো বিদেশে টাকা পাচার করার সুযোগ নেই। গত দশ বছরে কারা এভাবে অর্থের মালিক হয়ে গেছেন? এর উত্তর পাওয়া মনে হয় খুব কঠিন বিষয় নয়। বলা হচ্ছে বিপুল অর্থ চলে গেছে আমদানি-রফতানির ভুয়া তথ্য দিয়ে। আন্ডার ইনভয়েস বা ওভার ইনভয়েসের জন্য ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য ছাড়া সম্ভব নয়। যদি আমরা ধরে নেই পাচার হওয়া টাকার একটি অংশ ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিনিয়োগ করছে তা হলেও প্রশ্ন আসে কেন ব্যবসায়ীরা দেশে বিনিয়োগ করার আগ্রহ পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব তো সরকারের। এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালে মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের ৯ থেকে ১৩ শতাংশ অর্থ পাচার হয়েছে সরাসরি পদ্ধতিতে। আমদানি-রফতানিতে জড়িত না থেকেও যারা বিপুল টাকার মালিক হয়েছেন যারা, ধরে নিতে পারি এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এভাবে টাকা পাচারের সাথে জড়িত। এরা কারা? কান পাতলে আমরা হয়ত তাদের নাম শুনতে পারব। যারা কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় বেগম পল্লী গড়ে তুলেছেন।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণরা যখন কাজের সন্ধানে বিদেশ যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ডুবছে তখন ইউরোপ বা আমেরিকাতে কেউ কেউ বাড়ি কিনছেন। যে তরুণ কাজ না পেয়ে পথে পথে ঘুরছে তার কাছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল বা উড়াল সড়কে কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের দরকার এক সাথে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান। ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দৃশ্যমান বা চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন মানুষের কোনো উপকারে আসে না এর বহু উদাহরণ আছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর প্রকৃত উন্নয়ন তখন হবে যখন কাজের সন্ধানে যাওয়ার জন্য মানব পাচার বন্ধ হবে। মানব পাচার বন্ধের জন্য দরকার কাজের সংস্থান করা। আর এ জন্য বন্ধ করতে হবে টাকা পাচার। কিন্তু সে দিকে ক্ষমতাসীনদের আগ্রহ আছে এমন অবস্থা আমরা দেখছি না। টাকা পাচার যারা করছেন তারা সমাজ ও রাজনীতিতে অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন। বলা যায় তারা এখন দেশ নিয়ন্ত্রণ করছেন।
alfazanambd@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/218791