২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ২:১৪

আয় না বাড়লেও বেড়ে চলেছে ব্যয়ের পরিমাণ

আশিকুল হামিদ

দেশের নিত্যপণ্যের অস্থির বাজারে প্রতিদিন যে সব পণ্যের দাম শুধু বেড়েই চলেছে সে তথ্যের উল্লেখ করার নিশ্চয়ই দরকার পড়ে না। বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশনসহ সকল গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত রিপোর্ট নিয়মিতভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক তার প্রধান রিপোর্টে জানিয়েছে, একজন চাকরিজীবীর পক্ষে বর্তমানে ৫০ হাজার টাকায়ও মাস চালানো এবং মাসের সংসার খরচ সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঠিক কত শতাংশ চাকরিজীবীর মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকাÑসে প্রশ্নের সঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্যে এ কথাও জানানো হয়েছে যে, ওই সংখ্যা বা শতাংশের খোঁজে সময় নষ্ট না করাই ভালো। কারণ, এত বেশি অর্থ খুব কম মানুষই আয় করতে পারে।  

বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে তৈরি করা রিপোর্টটিতে ২০২০ থেকে চলতি বছর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে স্ত্রী এবং দুই ছেলে ও এক মেয়ের সমন্বয়ে তৈরি চার সদস্যের সংসারের মাসিক খরচের হিসাব তথা পরিসংখ্যান উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ২০২০ খ্রিস্টাব্দে মোটা যে চালের দর ছিল ৩৬ টাকা ৫০ পয়সা সে একই চাল এখন কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ওই চাল যে ৪৫ টাকা দরে কেনা যেতো সে কথারও উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে। এতে দেখা গেছে, প্রথম বছরে আট টাকা ৫০ পয়সা বাড়লেও দ্বিতীয় বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে দশ টাকা! 

একইভাবে ৬০ টাকা কেজি দরের নাজিরশাইল চাল প্রথম বছরে ৬৬ টাকা এবং বর্তমানে ৭৫ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। পণ্যমূল্যের এই তালিকায় আটা ও ময়দার দর দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ২৩ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে ৩৩ টাকা ৫০ পয়সা এবং ৫৫ টাকা পর্যন্ত। প্রথম বছরে যে সয়াবিন তেলের এক লিটার খোলা বাজারে ১০৫ টাকায় পাওয়া যেতো, সেটাই রিপোর্টের প্রকাশকালে ১৬০ দরে কিনতে হচ্ছিল। একইভাবে বেড়েছে অন্য সকল পণ্যের দামও। চিনি থেকে মসুর ডাল ও ব্রয়লার মুরগি পর্যন্ত এমন কিছুর কথা বলা সম্ভব হয়নি, যার দাম না বেড়েছে। গরুর মাংসের তো ধারেকাছেই যেতে পারেননি রিপোর্টার। তাকে বরং লিখতে হয়েছে, টাকার টুথ পেস্ট থেকে এলপি গ্যাস পর্যন্ত প্রতিটি পণ্যের দামই লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। এসবের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাসা ভাড়া থেকে সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয়, বিদ্যুতের বিল এবং ওষুধের দাম ও যাতায়াত খরচ পর্যন্ত সবকিছুর খরচ।

প্রকাশিত রিপোর্টে একজন চাকরিজীবীর মাসিক খরচের হিসাব উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, আগে যেখানে ৫০ হাজার টাকা বেতনের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন ব্যয় মেটানোর পর ১৪ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে কোনোভাবে বাকি সব খরচ মেটানো সম্ভব হতো বর্তমানে সেখানে একই টাকায় কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। ফলে প্রতি মাসেই বাড়ছে টানাটানির পরিমাণ। বাড়ছে ধারদেনার পরিমাণও। বড়কথা, ধারদেনাও আর আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, আত্মীয়-স্বজনসহ সকল মানুষেরই আয় অনেক কমে গেছে এবং কারো আয়-রোজগারই বাড়ছে না। প্রকাশিত রিপোর্টে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্য সকল স্থানে তো বটেই, এমনকি ‘দেশের শস্য ভান্ডার’ নামে বিখ্যাত দিনাজপুরেও চালের দাম বেড়ে চলেছে! 

পণ্যের দাম বেড়ে চলার জন্য সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও দোকানদাররাও আমদানিকারকসহ বড় ব্যবসায়ীদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মজুদ গড়ে তোলার অভিযোগ এনে তারা বলেছেন, সরকারের উচিত অসৎ ও বড় ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ডের বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা এবং তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রীও চোরাচালানী ও মজুতদারদের সতর্ক করে বলেছেন, গত বছর আম্ফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলেও চালের দাম বাড়ানো হয়নি। অন্যদিকে চলতি বছর ফলন তো ভালো হয়েছেই, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ফসলের ক্ষতি হয়নি। একই কারণে চালের সংকট বা মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তি বা কারণ থাকতে পারে না। যারা দাম বাড়ানোর কর্মকান্ডে যুক্ত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন খাদ্যমন্ত্রী। অন্য কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাও তাদের বক্তব্যে একই রকম কঠোর মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। 

এমন অবস্থার কারণ হিসেবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বর্তমান পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর যুক্তি দেখিয়ে খাদ্যের আপৎকালীন মজুত থেকেও কয়েক লাখ টন পর্যন্ত চাল বের করে এনে থাকেন। কম দামে বিক্রি করা ছাড়াও ওই সব চাল ভিজিএফ এবং ওএমএস ও কাবিখা ধরনের কিছু অপরিকল্পিত কর্মসূচিতে বিলি-বন্টন করা হয়। এরই পাশাপাশি মধ্যস্বত্ত্বভোগী টাউট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কারণে এ বছরও আমন, আউশ বা দ্বিতীয় কোনো ফসল সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হাওর অঞ্চলের আকস্মিক বন্যার মতো দুর্যোগ। বেশ কিছু এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বোরোর আবাদ। তা সত্ত্বেও কৃষকদের লাভজনক মূল্য দেয়া হলে তারা হয়তো সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতো এবং তার ফলে সরকারি গুদামগুলোতে কোনো ঘাটতি ঘটতো না। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষে নেয়া হয়নি। তাছাড়া চাল আমদানির ব্যাপারেও সরকারকে তৎপর হতে দেখা যায়নি। আমদানির নীতি-কৌশল নির্ধারণ করার নামে আসলে একটি ব্যাপারেই কর্তা ব্যক্তিরা বেশি ব্যস্ত থেকেছেনÑ আমদানির সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব যাতে বিশেষ গোষ্ঠীর লোকজনের হাতে রাখা যায়। এর ফলে আমদানির ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়েছিল সরকার। ওদিকে পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি রেখেছে অতি মুনাফাখোর টাউট ব্যবসায়ীরা, যারা সব সময় সিন্ডিকেট তৈরি করার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। 

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারকে প্রতিটি পণ্যের ব্যাপারেই একই রকম কঠোর নীতি ও মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। কুচক্রী ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা প্রতিরোধের লক্ষ্যেও সরকারের উচিত তৎপর হওয়া, যাতে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নতুন নতুন সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে না পারে এবং কোনো গোষ্ঠীর পক্ষেই যাতে পণ্যের মূল্য বাড়ানো সম্ভব না হয়। সব মিলিয়েই পর্যবেক্ষকরা কঠোর মনিটরিং করাসহ সর্বাত্মক পন্থায় বাজার ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, প্রতিটি পণ্যের ব্যাপারেই এমন ব্যবস্থা নেয়া দরকার, যাতে কোনো গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেটের পক্ষে যথেচ্ছভাবে দাম বাড়ানো সম্ভব না হয়, যাতে সকল পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের সাধ্য ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে।

https://www.dailysangram.info/post/544520