২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৪:৫৫

সর্বত্রই পোশাক রফতানি কমেছে

 

জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া পোশাক রফতানিকারকদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও বিশ্ব বাজারে পোশাকের খুচরা ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে কার্যাদেশ কমে যাওয়ায় ছোট ও মাঝারি আকারের পোশাক কারখানাগুলোর টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি ডলার সঙ্কট এবং অস্থিতিশীল আর্থিক পরিস্থিতিতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার (স্যাংশন) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘নির্বাচনের সুস্থ পরিবেশ’ বিশ্বের বড় বাজার হারানোর শঙ্কা। এছাড়া গ্যাসের তীব্র সঙ্কট পোশাক শিল্পে যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। আর এর মধ্যে শঙ্কার খবর তৈরি পোশাকের বড় সব বাজারে রফতানি কমেছে। শ্রম অধিকার নিয়ে স্যাংশনের হুমকির মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান দুই বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় পোশাক রফতানি কমেছে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের পাঁচ মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পোশাক রফতানি কমেছে শূণ্য দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার বা ২০০ মিলিয়ন ডলার।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-নভেম্বর) প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি হয়েছে ৩ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশের মোট রফতানির ১৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ কম। আগের বছর একই সময় রফতানি করেছিল ৩ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে দেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতেও রফতানি কমেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, একক রাষ্ট্র হিসেবে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র এবং জোটগত বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) প্রধান এ পণ্যের রফতানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে কম। আরেক বাজার কানাডাতেও একই চিত্র। তৈরি পোশাকের মোট রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশের মতো আসে প্রচলিত এসব বাজার থেকে। প্রচলিত বাজারে রফতানি কমে যাওয়া ভাবিয়ে তুলেছে উদ্যোক্তাদের। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে রফতানি খাতের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং শ্রম অধিকার রক্ষার ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা আগামী দিনে রফতানিতে প্রভাব ফেলবে কিনা, তা নিয়ে রফতানিকারকদের উদ্বেগ রয়েছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বড় বাজার। রাজনৈতিক কারণে ওই সব বাজার ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যেই গ্রাস-বিদ্যুতের ঘাটতি গোটা শিল্পের জন্য অশনি সংকেত।
রফতানি কমে আসার কারণ ও পরিণতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, প্রচলিত বাজারে রফতানি কমে আসা অবশ্যই উদ্বেগের। বড় বাজারে রফতানি কমে আসার কারণে চলতি অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে পোশাক রফতানি হয়তো ঋণাত্মক ধারায় নেমে যেতে পারে।

বিজিএমইএ সভাপতি উল্লেখ করেন, কেবল বাংলাদেশেরই রফতানি কমেছে, তা নয়; ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রতিযোগী সব দেশেরই রফতানি কমছে। প্রধান দুই প্রতিযোগী চীন ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের রফতানি কমে আসার হার কম। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে চাহিদা কমে আসা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর নানা নীতির কারণে রফতানি কমছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ইইউতে রফতানি কম হয়েছে শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে সেখানে রফতানি ৪ শতাংশের বেশি ছিল। গত তিন অর্থবছরের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছর ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানি বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়েছিল ৩৪ শতাংশ এবং এর আগের অর্থবছরে বেড়েছিল ১৪ শতাংশ। গত পাঁচ মাসে জোটের দেশগুলোতে রফতানি হয় ৯০৫ কোটি ডলারের পোশাক, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৯০৭ কোটি ডলার। মোট রফতানি আয়ে ইইউর অংশ ৪৯ দশমিক ৪৮ থেকে ৪৭ শতাংশে নেমেছে।

ইইউর মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার জার্মানি। বছরে ৭০০ কোটি ডলারের মতো পোশাক রফতানি হয় দেশটিতে। গত পাঁচ মাসে জার্মানিতে রফতানি কম হয়েছে ১৫ শতাংশ। রফতানি হয়েছে ২৩১ কোটি ডলারের পোশাক। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৭২ কোটি ডলার। জার্মানিতে রফতানি কমেছে ৪১ কোটি ডলার বা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি। বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, জার্মানি অনেকটা মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য কমেছে। আমদানি-রফতানি সবই কমেছে। এ কারণে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেরও পোশাক রফতানি কমেছে।

প্রচলিত অন্য বাজারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গত পাঁচ মাসে পোশাক রফতানি কম হয়েছে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ৩২৮ কোটি ডলারের পোশাক গেছে সে দেশে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। রফতানি কমেছে ২০ কোটি ডলার বা প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার। রফতানি কমে যাওয়ার কারণে মোট পোশাক রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৯ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি কমে আসার কারণ হিসেবে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অনেকে বলার চেষ্টা করছেন যে রাজনৈতিক কারণে নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমেছে। তবে এখন পর্যন্ত রাজনীতি এর কারণ নয়। দেশটিতে চাহিদা কমে আসার কারণে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেরও রফতানি কমেছে। অবশ্য আগামীর কথা বলা যায় না। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার মিত্রদের নিয়েই তা কার্যকর করে থাকে।

আলোচ্য পাঁচ মাসে প্রচলিত অন্য বাজার কানাডায় রফতানি কম হয়েছে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ। ৬১ কোটি ডলারেরও কিছু কম মূল্যের পোশাক রফতানি হয় দেশটিতে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬২ কোটি ডলারের বেশি। পোশাকের মোট রফতানিতে এ বাজারের অংশ ৩ দশমিক ৪০ থেকে ৩ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে এসেছে।

বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘নির্বাচনের সুস্থ পরিবেশ’ এর প্রভাব এখনো পড়েনি। জার্মানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তার বড় কারণ হতে পারে। তিনি মনে করছেন, অর্থনৈতিক মন্দা এর বড় কারণ হতে পারে। এদিকে আরেক শীর্ষ রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ভালো করতে পারছে না। ঋণের চাপ ও অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে দেশগুলো।

https://dailyinqilab.com/national/article/626724