৯ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫৭

পর্যবেক্ষক নিয়োগের পরও নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাংকিং খাত

জালিয়াতি অর্থ পাচার অব্যাহত

অনিয়ম, জালিয়াতি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি থাকলেও ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা অব্যাহত আছে। অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের বন্ধক দেখিয়ে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিচালকরাই লুট করছেন ব্যাংকের টাকা।
পাশাপাশি এলসি (ঋণপত্র) জালিয়াতি, অফশোর ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে চলছে অর্থ পাচার। কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই নয়, বেশকিছু বেসরকারি ব্যাংকও এসব অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৪টি ব্যাংক ও ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। এ ছাড়া আরও একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে শুভঙ্কর সাহা, জনতা ব্যাংকে আহমেদ জামাল, অগ্রণী ব্যাংকে মিজানুর রহমান, রূপালী ব্যাংকে শেখ আবদুল্লাহ পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছেন। তারা চারজনই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কর্মকর্তার মধ্যে কৃষি ব্যাংকে রেজাউল ইসলাম, বিডিবিএলে আশরাফুল আলম, বেসিক ব্যাংকে জোয়ারদার ইসরাইল হোসেন, ইসলামী ব্যাংকে মো. শাহ আলম, ন্যাশনাল ব্যাংকে আজিজুর রহমান, ফারমার্স ব্যাংকে আবুল কাশেম, এনআরবিসি ব্যাংকে মাসুদ বিশ্বাস, এবি ব্যাংকে শেখ মোজাফফর হোসেন, কমার্স ব্যাংকে মনোজ কুমার বিশ্বাস এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে এ কে এম আমজাদ হোসেন পর্যবেক্ষক হিসেবে রয়েছেন। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তা। তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিআইএফসিতে এস এম রবিউল হোসেন, পিপলস লিজিংয়ে মো. আহমদ আলী ও ফার্স্ট ফিন্যান্সে মো. আবু তাহের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছেন। তারাও বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকসূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালীর পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। ব্যাংকগুলোয় বার বার একই ধরনের অনিয়ম-জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি আদায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো নানা অনিয়ম করছে। গত এক বছরে ব্যাংকগুলোয় কয়েক হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এলসি জালিয়াতির ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা জড়িত। প্রমাণ পাওয়ার পরও কোনো কোনো ব্যাংক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত না করে বরং পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদকে মামলা রয়েছে। এসব মামলা ঠেকিয়ে তারা পদোন্নতি পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। জানা যায়, নজরদারির মধ্যেও প্রতি বছর বাড়ছে অর্থ পাচার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক তদন্তে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে হুন্ডি বেড়ে যাওয়ার কথা জানা গেছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে গত মাসে একটি বেসরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন শ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়াা যায়। তবে ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালে সোনালী ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পরও ব্যাংকটির লোকসানি শাখা বেড়েছে। ব্যাংকটির আগের বছরের লোকসানি শাখা ছিল ১২৪টি। ২০১৬ সালে তা বেড়ে ২৩৩টিতে ঠেকেছে। একই বছরে ব্যাংকটির ৮১৯ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। এটি আগের বছরের চেয়ে ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। কেন এই অবস্থা— জানতে চাইলে ব্যাংকটির পর্যবেক্ষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি পর্যবেক্ষক হিসেবে কতটুকু উন্নতি করতে পেরেছি, তার চেয়ে বড় কথা এর চেয়ে খারাপ হতে পারত। ’ জনতা ব্যাংক মুনাফায় থাকলেও প্রতি বছর এর পরিমাণ কমছে। পর্যবেক্ষক নিয়োগের এক বছর পর ২০১৬ সালে ব্যাংকটি আগের বছরের চেয়ে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা কম মুনাফা করেছে। খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। জানতে চাইলে ব্যাংকটির পর্যবেক্ষক আহমেদ জামাল বলেন, ‘আগে কী ছিল তা নিয়ে আমি কোনো কথা বলব না। তবে বর্তমানে যে ঋণ ছাড় করা হচ্ছে, সেগুলো গুণমানসম্পন্ন। আর বর্তমান পর্ষদ খুব কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ’ জালিয়াতির অভিযোগে গত বছর অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে চাকরিচ্যুত করা হয়। এর পরও থামেনি ব্যাংকটির ঋণ জালিয়াতি। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৫৪ কোটি থেকে বেড়ে ৫ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ সম্পর্কে অগ্রণী ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কোনো মন্তব্য করতে সম্মত হননি। রূপালী ব্যাংকে বর্তমানে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে। এর আগের বছর খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা।
পর্যবেক্ষক নিয়োগের পর প্রায় ১২০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। একই সঙ্গে লোকসানি শাখা ১০টি থেকে বেড়ে গত ডিসেম্বরে ৮৬টিতে পৌঁছেছে। ব্যাংকটি আগের বছর ৮৪ কোটি টাকা মুনাফা করলেও এবার লোকসান দিয়েছে ৫০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির দুরবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে এই ব্যাংকের পর্যবেক্ষক শেখ আবদুল্লাহ কিছু বলতে সম্মত হননি। ব্যাংকিং খাতের অব্যাহত বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও জালিয়াতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকগুলোয় সুশাসনের তীব্র অভাব রয়েছে। নজরদারি যেভাবে হওয়া উচিত তা হচ্ছে না। ’ অর্থ পাচার সম্পর্কে বলেন, ‘আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কমে যাওয়ার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে অর্থ পাচার। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে না পারাটাও অর্থ পাচারের একটি কারণ। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমাসহ সার্বিক আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি না হারানোর নিশ্চয়তা দিতে হবে। ’

http://www.bd-pratidin.com/last-page/2017/05/09/230133#sthash.doVLtJWY.dpuf