২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৩:৪০

ডলারের গোপন দরে বৈষম্য বাড়ছে

আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে চলতি মাসে বেশি দামে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ব্যাংকের নির্ধারিত দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। বাড়তি সেই দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে ভিন্ন উপায়ে।

ফলে ব্যাংকেই প্রকাশ্যে দিতে হচ্ছে এক দাম, আর অন্যভাবে দিতে হচ্ছে বাড়তি দাম।

ব্যাংক সূত্র জানায়, বর্তমানে নির্ধারিত দামের চেয়ে ১২ থেকে ১৩ টাকা বেশি দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে। এর পরও ডলার দ্রুত পাওয়া নির্ভর করছে ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকগুলোর প্রভাব ও কৌশলের ওপর। ফলে এলসি খোলা কমেছে অর্ধেকের বেশি।

বর্তমানে আমদানিতে ডলারের নির্ধারিত দাম ১১০ টাকা। এই অবস্থায় বিলাস পণ্য আমদানি সাময়িক বন্ধ রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ডলার সংকটের সুযোগে ব্যাবসায়িক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণপত্র খোলা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তাই কাউকে বঞ্চিত না করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবাইকে এলসি খোলার সুযোগ দিতে হবে।

এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল ছাড়া অন্য সব বিলাস পণ্য আমদানি আগামী ছয় মাসের জন্য বন্ধ রাখতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ডলারের দাম বাজারের ওপর ছাড়ার পর ব্যাংকারদের দুটি সংগঠন ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) যৌথ সভায় একাধিকবার ডলারের দাম কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে নির্ধারিত দামে ডলার মিলছে না। বর্তমানে আমদানিতে ডলারের নির্ধারিত দাম ১১০ টাকা।

তবে কিনতে হচ্ছে আরো বেশি দামে।

বাংলাদেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে ২০২১ সালের ২২ আগস্ট থেকে। তখন ডলারের দাম ৮৪ থেকে ৮৫ টাকায় উঠে আসে। দুই বছরের ব্যবধানে সেটি বেড়ে হয় ১১০ টাকা। ডলার সংকটের কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত আমদানি বিল মেটানোর পাশাপাশি অদৃশ্য নানা কারণে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয় সময়মতো পুরোপুরি না আসাও ডলার সংকটের অন্যতম কারণ বলা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলারের বাজারে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে হুন্ডি। যারা বিদেশে ডলার নিয়ে যাচ্ছে, তারা বেশি দাম দিয়ে হলেও ডলার কিনতে চায়। এটা বাজারে চাহিদা তৈরি করছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে রিজার্ভে অতিরিক্ত ডলার যোগ করতে হবে। চলতি মাস শেষে নিট রিজার্ভ হতে হবে ১৭.৭৮ বিলিয়ন বা এক হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার। বর্তমানে প্রকৃত রিজার্ভ এরও নিচে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী নিট রিজার্ভ ২০.৬৮ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৬৮ কোটি ডলার। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকও রিজার্ভ ছেড়ে ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে পারছে না।

বেশি দাম দিলেও যে সব গ্রাহক সব ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছেন তা-ও নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে অনেক প্রভাবশালী ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনছে। এসব ব্যাংকের নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহক ডলার পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক আমদানি দায় পরিশোধেও বেশি দাম নিচ্ছে। ব্যবসায় প্রভাব খাটানো ব্যাংকগুলোই এখন ভালো ব্যবসা করছে। ডলারের সংকট এখনো রয়েছে বলে স্বীকার করলেও বিস্তারিত বলতে রাজি হননি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

ডলারের এই সংকটের প্রভাব বেশি পড়ছে সেসব ব্যাংকে, যেসব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক ডলার বেশি দামে কেনা যাবে, কিন্তু বেশি দামে বিক্রি করা যাবে না।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখ্ত বলেন, ‘অনেক ব্যাংক কম দামে ডলার কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে। এটি সবাই পারবে না। যারা পারছে না, তারা ডলার সেভাবে পাচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে আমরা সে অনিয়ম করতে পারছি না।’

পেঁয়াজ ও রসুন আমদানিকারক পরেশ পোদ্দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের আমদানি প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। এলসি খুলতে পারছি না। আগে মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মার্জিন দিয়ে এলসি খোলা গেলেও বর্তমানে ১২০ শতাংশ দিতে হয়। ডলারের সংকট এবং দর বেশি হওয়ায় এলসি করতে ব্যাংকগুলো নিরুৎসাহ করে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/12/26/1349087