৯ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫১

হঠাৎ বেড়েছে অপহরণ

ঘটনা—১ : ৩ মে রাজধানীর পল্টন এলাকার অফিস থেকে কাজ শেষে রাত ৯টার দিকে বাসায় ফিরছিলেন আবদুুল করিম নামের এক লোক। মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে তেজগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার সময় দুটি মোটরসাইকেল তার গতি রোধ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন তার শরীরে অস্ত্র ঠেকায়। তারপর তাকে মোটরসাইকেলের মাঝখানে বসিয়ে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। সেখানে নির্মম নির্যাতনের শব্দ শুনিয়ে তার ভাই আবদুর রহমানের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে এই দুর্বৃত্তরা। পরদিন এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয় রমনা থানায়। একই সঙ্গে অবহিত করা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। শুরু হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা। এক পর্যায়ে গত শুক্রবার রাতে মোটরসাইকেলটিসহ (ঢাকা মেট্রো ল-২৩-৪৭০১) গুরুতর অবস্থায় ভিকটিমকে তেজগাঁওয়ে ফেলে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। আবদুল করিম এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তিনি জীবিত।
ঘটনা—২ : নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকা থেকে আট বছর বয়সী শিশু বায়েজিদকে উদ্ধারের পর র্যা ব—১১-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলেপ উদ্দীন উদ্ঘাটন করেন অপহরণকারী চক্রের গা শিউরে ওঠা নৃশংসতা। মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায় ভয়ঙ্কর এই অপহরণকারী সিন্ডিকেটের কর্মকাণ্ড। গ্রেফতার করা হয় সিন্ডিকেটের সাত সদস্যকে। র্যা বের জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন নাজমুল ও আকাশ নামের দুই অবুঝ শিশুকে তারা কীভাবে পেট কেটে ইট বেঁধে শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছেন।
র্যা ব—১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, ‘আমাদের ধারণা কেবল এই চক্রটি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্ধশতাধিক শিশুকে অপহরণ করেছে। এ পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ১৮টি শিশুর ব্যাপারে তথ্য আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ৯ শিশুকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ২ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ৬ শিশুকে পাচার করা হয়েছে। সর্বশেষ তাদের হেফাজত থেকে আমরা বায়েজিদকে উদ্ধার করেছি। ’ তিনি আরও বলেন, ‘ওমানে অবস্থানরত শাহাবুদ্দীন এই চক্রের অন্যতম হোতা। তাকে গ্রেফতার করতে পারলে অনেক তথ্য আদায় করা সম্ভব। ’ অপহরণের ঘটনা সম্পর্কে আরও জানা গেছে, ২৬ এপ্রিল মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশি ছাত্র এনামুল হাসান ভূইয়া কাউসারকে জিম্মি করে ২০ লাখ টাকা দাবি করে অপহরণকারী চক্র। ২৭ এপ্রিল কাউসারের চাচা নজরুল ভূইয়া যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি করেন। এরই মধ্যে অপহূতের পরিবার ভয়ে ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে দেয়। সর্বশেষ ২৯ এপ্রিল আরও ১ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য দক্ষিণখান এলাকায় গেলে সেখান থেকে রাতুল নামের অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে পিবিআই। এর পরই অপহূত কাউসারকে ছেড়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকালে রাজধানীর হাজারীবাগের মনেশ্বর এলাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার আবুল কাশেমকে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে উঠিয়ে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী কয়েকজন। নিখোঁজের দুই দিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের আম্বরখানার একটি রাস্তা থেকে তাকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করেন তার স্বজনরা। এর মাঝে শ্রীমঙ্গলের গহিন একটি জঙ্গলে দুর্বৃত্তরা আবুল কাশেমসহ অপহূত আরও দুজনকে নির্মম নির্যাতন করে বলে জানিয়েছেন উদ্ধার হওয়া ব্যক্তির স্বজন একরামুল হক খান। তবে আবুল কাশেমের মুক্তিতে কোনো পণ দিতে হয়েছে কিনা, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। নিখোঁজের দুই দিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি গুলশান—১-এর ২/এ নম্বর সড়কের পাশের একটি লেক থেকে উদ্ধার করা হয় মেহেদী হাসান জাহিদ নামে এক যুবকের লাশ। নিহতের স্ত্রী সুমী আক্তারের অভিযোগ, তার স্বামীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁও থেকে অপহরণের তিন দিন পর ৪ নভেম্বর দুপুরে মানিকগঞ্জের ঘিওরে মেলে সিএ ফার্মের কর্মকর্তা মো. মোখলেসুর রহমানের অর্ধগলিত লাশ। ২৭ জুলাই ভোর রাতে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য সোনারগাঁও ট্রাফিক সিগন্যালের পাশ থেকে অপহূত হন ইস্কাটন লেডিস ক্লাবের পাচক রিয়াজুল ইসলাম। তার মুক্তিপণ বাবদ স্বজনরা অপহরণকারীদের কিছু টাকা বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করলেও পরে নিউমার্কেট থানা এলাকায় পাওয়া যায় রিয়াজের লাশ। ২২ জানুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ভিড়ের মাঝ থেকেই মিরপুর বাঙ্লা কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগ হোসেনকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজন। ৭ জানুয়ারি মিরপুর শাহআলী প্লাজা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে হাসান নামে এক দোকান কর্মচারীকে তুলে নেওয়া হয়। ১৬ জানুয়ারি মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের শান্তিপুর থেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহূত এক নারীকে উদ্ধার করে পুলিশ। ১৫ অক্টোবর ভোর রাতে পুলিশের টহল গাড়ির সামনেই রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় অপহূত হন ইকবাল মাহমুদ নামে এক চিকিৎসক। ডা. ইকবালকে অপহরণের সময় ঘটনাস্থলে থাকা গাড়িটি যে পুলিশের ছিল অপহরণের তিন মাস পর আদালতে দেওয়া এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে খোদ পুলিশই। ওই চিকিৎসককে উদ্ধারে নিষ্ক্রিয়তা কেন কর্তব্যে অবহেলা হিসেবে গণ্য করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছে হাই কোর্ট। ১৪ জুলাই রাজধানীর বনানী রেলস্টেশনের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে তুলে নেওয়া হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইয়াসিন মোহাম্মদ আবদুস সামাদকে। গতকাল পর্যন্ত ওই ব্রিটিশ নাগরিকের হদিস মেলেনি। এদিকে গোয়ন্দো সূত্রগুলো বলছে, অন্তত ৫০টি ভয়ঙ্কর চক্র রাজধানীসহ সারা দেশে সক্রিয় রয়েছে। এর বেশির ভাগ চক্রই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আবার খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরাও সাধারণ মানুষকে অপহরণের নামে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। কিছু চক্র প্রবাসীদের অপহরণ করে দেশ থেকে আদায় করছে মুক্তিপণ। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য বলছে, রাজধানীতে গত বছর ১০৩ জন অপহূত হন। এই হিসাবে প্রতি তিন দিনে একজন অপহূত হয়েছেন। কেউ কেউ ভাগ্যক্রমে ছাড়া পেলেও অনেকের লাশ মিলছে রাস্তায়, ডোবা, নালা ও নদীতে।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার যুবলীগ নেতা আতিকুর রহমান উজ্জ্বলকে রাজধানীর উত্তরা থেকে অপহরণ করেছিল বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) কর্মরত সহকারী পুলিশ কমিশনার রুহুল আমীন সরকারের নেতৃত্বে একটি দল। টানা ২১ দিন আটকে রেখে উজ্জ্বলকে অমানুষিক নির্যাতনের পর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মুক্তি দেওয়া হয়। উজ্জ্বলের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, উজ্জ্বলের অপরাধ ছিল তিনি রুহুল আমীনের চাচার বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। জানা গেছে, এই ডিবি কর্মকর্তা ১৮ এপ্রিল কাফরুলের একটি ক্লাবে লুটপাট করে পালিয়ে যাওয়ার সময় মিলিটারি পুলিশের হাতে আটক হন। বর্তমানে তিনি সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় রয়েছেন। এর পর থেকে বেরিয়ে আসছে এই পুলিশ কর্মকর্তার নানা অপরাধের বিবরণ। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গাড়িতে কালো কাচ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও মানা হচ্ছে না সেই আদেশ। তা ছাড়া প্রশাসনের পর্যাপ্ত নজরদারিরও অভাব রয়েছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, বিভিন্ন অপরাধের মতো অপহরণও নিয়ন্ত্রণে আছে। অপহরণকারীদের গ্রেফতার এবং অপহূতকে উদ্ধারের ঘটনাই বেশি। র্যা বের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্্) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অভিযোগ পেলে দেশে হোক কিংবা বিদেশে, অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধারে র্যা ব সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। অপহূতদের উদ্ধারে র্যা বের অনেক সফলতা রয়েছে। চলতি বছরই শিশু অপহরণকারী চক্রের নৃশংসতার বিষয়টি উদ্ঘাটন করেছে তারা। চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার এবং অপহূত শিশুদের উদ্ধার করেছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ১০৩ জনকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ২০১৫ সালে রাজধানীতে অপহরণের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মামলা হয় ১৪৬টি। কিন্তু অপহরণের বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। অনেক ক্ষেত্রে ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে অনেক ভুক্তভোগী বা তাদের স্বজনরা অভিযোগ জানাতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট দফতরে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে মাত্র দুজন অপহরণের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালের তুলনায় গত বছরে গুম-গুপ্তহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও খুনের ঘটনার শিকার হন মোট ৯৭ জন। পরে ১১ জনের লাশ উদ্ধার হয়, ২৬ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়, পরিবারের কাছে ফেরত এসেছেন ৩ জন, বাকিদের হদিস মেলেনি। ২০১৫ সালে অপহরণ, গুম ও খুনের ঘটনার শিকার হন ৫৫ জন।
আসকের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, মাঝে মাঝেই অভিযোগ ওঠে ভুক্তভোগীদের কান্না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মন গলাতে পারে না। এক পর্যায়ে নিখোঁজ হতভাগা ব্যক্তির সন্ধান মেলে লাশ হিসেবে। অনেক ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততাও পাওয়া যাচ্ছে। গেল কয়েক বছর এই গুম, অপহরণের সংখ্যা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যা স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সমাজে ধারাবাহিকভাবে চলতে পারে না। এর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। রাষ্ট্রকেই খুঁজে বের করতে হবে এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন জানান, দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকার পরও ভিকটিম উদ্ধার না হওয়া সত্যিই হতাশাজনক। এর দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। এসব ঘটনা কমিয়ে আনতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য মত দেন তিনি। রাজধানী থেকে একজন ব্রিটিশ নাগরিক অপহরণের ঘটনাটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো পরিষ্কার জবাব আমরা পাইনি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিস্তার ঘটলে রাষ্ট্রে অপরাধের মাত্রা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। ’ ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, ‘রাজধানীতে অপহরণের ঘটনা বেড়েছে এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। অপহরণের কোনো অভিযোগ পেলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভিকটিমকে উদ্ধারসহ অপরাধীদের গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হয়। অপহরণ কিংবা কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত, এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ’

http://www.bd-pratidin.com/first-page/2017/05/09/230110