২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৩:২৩

ইতালীতে মাতৃত্ব সংকট ও জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যা

-ড. মো. নূরুল আমিন

আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে স্পন্সর ভিসায় ইতালীতে চাকরি অভিবাসন প্রত্যাশী বিপুল সংখ্যক লোক নেয়া হবে বলে ব্যাপক গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। জানা শোনা পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই যোগাযোগ করে খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ খবরটি সত্য কিনা তা জানতে চেয়েছেন।

বাংলাদেশে শিক্ষিত অশিক্ষিত, দক্ষ অদক্ষ উভয় শ্রেণীর কর্মক্ষম লোক দেশে চাকরি বাকরির অভাব, নিন্ম পর্যায়ের বেতন কাঠামো, অবিশ্বাসী গতিতে জিনিসপত্র ও সেবা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ঊর্ধ্ব হারের বেতন ও সমৃদ্ধির আসায় বিদেশমুখী হয়ে গেছেন। আগে তাদের বেশির ভাগ লোকের গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, এখন তা বদলে পাশ্চাত্যমুখী হয়ে গেছে বলে মনে হয়। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান এখন তাদের স্বপ্নের দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছিল তাদের জন্য কর্মসংস্থান বা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এসব দেশে অভিবাসন বা নাগরিকত্ব প্রদান বা গ্রহণের কোনও সুযোগ ছিল না, কিন্তু পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের কিছু দেশ একই সাথে বিদেশীদের কর্মসংস্থান ও নাগরিকত্ব প্রদানের সুযোগ দিচ্ছে এবং ঐসব দেশে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য আমাদের দেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে কর্মক্ষম হাজার হাজার যুবক যুবতি হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে এমনকি শ্বশুড় বাড়ি থেকে যৌতুক নিয়ে বিদেশ যাচ্ছে। কেউ কেউ দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্তও হচ্ছে। আমার জানা শোনা ঘনিষ্ঠ এক ভদ্রলোক কয়েক সপ্তাহ আগে গর্ব করে আমাকে জানালেন তার ছেলে অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পেয়েছে এবং তাকে এই বাবত ১৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। তিনি আরো জানালেন যে, তার পুত্র সেই দেশে যে চাকরিতে যোগ দেবে তার মাসিক বেতন বাংলাদেশী টাকায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। কথাটা আমার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হলেও একথা সত্য যে, আমাদের দেশের তুলনায় এসব দেশের শ্রমিকদের মজুরি বেশি। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, এত ধার কর্জ করে সম্পত্তি বিক্রি করে ১৭ লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে বিদেশ না পাঠিয়ে দেশে আট দশ লাখ টাকা খরচ করে একটা মুদি, স্টেশনারী বা ওষুধের দোকান ধরিয়ে দিলে কি ভাল হতো না? তিনি আমার প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেন।

ইতালীর স্পন্সর ভিসা দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। ইতালী অতি প্রাচীন একটি সভ্যতা সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি, খৃস্টের জন্মের পূর্ব থেকে রোম নগরী রোমান সাম্রাজের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। শিক্ষা দীক্ষা, শিল্প সংস্কৃতি, স্থাপত্য বিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্রে তারা অনেক অগ্রগামী ছিল। সারা বিশে^র ক্যাথলিক গীর্জার প্রধান পোপের সদর দফতরও ইতালীতে। অবশ্য পোপের (বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস) এই সদর দফতরটি ভ্যাটিকান সিটি নামে পরিচিত। আকারে মাত্র ২.৪৯ বর্গকিলোমিটারের হলেও ভ্যাটিকান সিটির একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে। এটি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। জনসংখ্যা ৮২০ জন। ইতালীর সাথে এর সীমান্তের আকার ৩.২ কিমি। এই সিটি রাষ্ট্রের শতকরা ১০০ ভাগ লোক রোমান ক্যাথলিক। তাদের মাথাপিছু জিডিপি ২১১৯৮.০০ ডলার। মধ্যযুগে ইতালীর পাডোবা বিশ^বিদ্যালয় সারা দুনিয়ায় একটি খ্যাতনামা বিদ্যায়তন হিসাবে পরিচিতি ছিল। অস্থিতন্ত্র (এনাটমি) শেখার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ ও বিশ্লেষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এখন এই দেশ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আবিষ্কার উদ্ভাবন কাজে আর সম্পৃক্ত নেই। বিশ্ববিদ্যালয়টির ধাত্রীবিদ্যা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মারিয়া তেরেসা গারভেসি কর্তৃক তার বিশ্ববিদ্যালয় নগরীর জনসংখ্যা হ্রাসজনিত সমস্যার ব্যবচ্ছেদে লিপ্ত থাকাই তার প্রমাণ। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে পারডোবা বিশ্ববিদ্যালয়টি তুলনীয় ছিল। পারডোবা বিশ্ববিদ্যালয় নগরীতে এই শতাব্দির প্রথম দশকে জন্ম হার বার্ষিক ২৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলসমূহে ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বহু স্কুল বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। পারডোবা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে প্রায় ৯ হাজার কর্মচারী কাজ করেন। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশই মহিলা। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সন্তান ধারণ ও লালন পালনের ব্যাপারে এদের প্রায় সকলেরই অনীহা লক্ষ্যণীয়; তারা যে শুধু মা হতেই চান না তা নয়, স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে শিশুদের পরিচর্যা করতেও আগ্রহী নন। ইতালীর সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের জন্য এই অবস্থা এক বিরাট উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ড. মারিয়া তেরেসা গারভেসি এই অবস্থাকে ইতালীর Demographic Winter বা জনসংখ্যা তাত্ত্বিক নিষ্প্রাণ আবহাওয়া বলে অভিহিত করেছেন। মহিলারা বিলম্বে বাচ্চা নেয়া বা একেবারেই না নেয়ার কারণে ইতালী ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে বলে তিনি মনে করেন। মহিলাদের মধ্যে যারা বাচ্চা নিতে চান তারা আবার গর্ভবতী হতে চান না কেননা তাদের প্রতি সামাজিক সংস্থাসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধুসুলভ নয়। এক্ষেত্রে তারা Surrogation এ বিশ্বাসী। সেখানে অনেক মহিলা আছে যারা গর্ভ ভাড়া দেয় এবং সন্তান জন্মের পর তাকে হস্তান্তর করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের লালন-পালনে মহিলাদের প্রয়োজন হয়। সরকার বাচ্চা পালনকারী মহিলাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা দেন না, ফলে এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহও হ্রাস পেয়েছে।

ইউরোপীয় দেশসমূহ এবং চীন জাপানসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং জন্মহার হ্রাস এক বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর বিরাট চাপ পড়ছে। তাদের বয়স্কভাতা ও পেনশন চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সম্ভাব্য অসহায় অবস্থার মোকাবেলা, দেখাশোনা প্রভৃতি কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা প্রভৃতিতে শ্রমিক-কর্মচারীর অভাব ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রসংখ্যাও হ্রাস পাওয়ায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।

অর্থনৈতিক স্থবিরতা, নারীদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি রাজনৈতিক উদাসীনতা প্রভৃতি ইতালীর জনসংখ্যা সংকটকে তীব্র করে তুলেছে। ইতালী একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ। তাদের সমাজ এখনো পরিবারকেন্দ্রিক, সন্তান প্রতিপালনে মায়েরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এটাই তাদের বিশ্বাস। ইস্টাট নামক একটি জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার জরিপ অনুযায়ী ইতালীর ৪৬ শতাংশ অধিবাসী দুটি সন্তানে বিশ্বাসী। অবশিষ্টরা তিন বা ততোধিক সন্তান প্রত্যাশী। তথাপি ইতালিয়ান মহিলাদের উর্বরতা ও গর্ভবতী হবার হার জনপ্রতি ১.২৪টি শিশু। এই হার দীর্ঘদিন চলে আসছে এবং ইউরোপের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২২ সালে ইতালীতে ৩,৯৩,০০০ শিশু জন্মগ্রহণ করেছে যা ২০২১ সালের তুলনায় ১.৮ শতাংশ ও একদশক আগের তুলনায় ২৭ শতাংশ কম। বলাবাহুল্য ১৮৬১ সালে ইতালী পুনরেকত্রিত হবার পর এটাই তাদের শিশু জন্মের বড় অধোগতি। 

জনসংখ্যা সংক্রান্ত ইতালীর একটি গবেষণা সংস্থা (ISTAT) সে দেশের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে আসন্ন একটি সংকটাবস্থার ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে, আগামী ২০৭০ সালের মধ্যে গড় ৫০ বছর বয়সী ইতালীর জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ৫৯ মিলিয়নের পরিবর্তে ৪৮ মিলিয়নে নেমে আসবে। ফলে ব্যাপক ঋণে জর্জরিত ইউরোপের এই দেশটির অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। অবশ্য জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আশাবাদের কথাও বলেছেন। তাদের মতে দেশটির সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে নারীদের মাথাপিছু সন্তান ধারণের হার যদি ১.৫ জনে উন্নীত করা যায় তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

ইতালীর প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মিলোনীর নেতৃত্বাধীন Brothers of Itali Party, God, Fatherland, Family এই স্লোগানকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী জনসংখ্যা হ্রাসের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। তার ডানপন্থী সরকার অধিক সন্তান জন্মদানের জন্য অনুপ্রাণিত করছেন এবং কর হ্রাসসহ বিভিন্নভাবে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ভ্যাটিকানে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে ইতালীর প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা সংকটের কথা উল্লেখ করে সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা জন্মহার বৃদ্ধি এবং পরিবার গঠনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এর সহজ কারণ হচ্ছে আমরা চাই ইতালী তার অতীত গৌরব ফিরিয়ে এনে তার সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুক। তার  ভাষায় ছেলেমেয়েরা হচ্ছে যেকোনো রকমের ভবিষ্যৎ ও পরিবার গঠনের ভিত্তিফলক। বলাবাহুল্য প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়ার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে যার বয়স ছয় বছর। পরিবার, জন্মহার ও সমঅধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত মন্ত্রী ইউজেনিয়া মারিয়া রকচেলা বলেছেন যে, সন্তান প্রতিপালন মহিলাদের প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত। তার মতে ইতালীতে মাতৃত্বকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। “আমি যদি বলি আমি একজন মা, তাহলে আমার সামাজিকভাবে পুরস্কৃত হবার সুযোগ নেই। আবার আমি যদি বলি আমি পেশাজীবী মহিলা বা Career Woman তাহলে মানুষ সম্মানের চোখে দেখে।” তার ভাষায় মায়েদের জন্য আলাদা শ্রদ্ধা, সম্মান ও সামাজিক স্বীকৃতি থাকা বাঞ্ছনীয়। বলাবাহুল্য এই মন্ত্রী ৭০-এর দশকে একজন কট্টর নারীবাদী ও গর্ভপাতের অধিকার আন্দোলনের একজন তুখোড় নেত্রী ছিলেন। 

জন্মহার হ্রাসের সাথে বিপুল হারে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে নিবন্ধন-বহির্ভূত অভিবাসীর আগমন দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি বিরাট হুমকির সৃষ্টি করেছে। দেশটির প্রাচীন ও রক্ষণশীল সাপ্তাহিক পত্রিকা প্যানারোমা সম্প্রতি ইতালীর একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছে। মানচিত্রটি জুড়ে আছে আফ্রিকার কালো আদমী ও হিজাব পরা মুসলিম মহিলাদের ছবি। শিরোনাম হচ্ছে Itali Without Italians অর্থাৎ ইতালীয়ান ছাড়া ইতালী।

কৃষিমন্ত্রী ফ্রান্সেসকো লোলো ব্রিগিডা প্রকাশ্যে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, অবিলম্বে যদি ইতালীয়ান দম্পতিরা সন্তান ধারণ ও সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধি না করেন তাহলে জাতিগতভাবে তাদের বিলুপ্ত হবার ঝুঁকি নিতে হবে। ইতালীবাসীর সন্তান সংখ্যা কম হওয়ায় আমাদের অন্য দেশের বাসিন্দাদের নিয়ে তাদের প্রতিস্থাপন করতে হচ্ছে। লোলো ব্রিগিডা হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মিলোনীর দেবর। তথাপি অর্থনীতিবিদ এবং জনসংখ্যাবিদরা এ ব্যাপারে সন্দিহান যে, অর্থনৈতিক উৎসাহ ও মাতৃত্বের অনুকূলে প্রচার-প্রপাগা-া কার্যত কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কেননা বাস্তবতা ও আদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতালীর সমাজে সন্তান পালন ও তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামঞ্জস্যহীন ও অসম্ভব। নারীবাদী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদরা মনে করেন যে, অধিকতর সন্তান ধারণের জন্য সে দেশের মহিলাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং তাদের স্বামীদের অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি যাতে করে তারা পারিবারিক জীবনের সাথে চাকরি-বাকরি তথা কর্মক্ষেত্রের সমন্বয় ঘটাতে পারে। যারা এদের সাথে একমত নন, তাদের কথা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মিলোনীর সরকার ইতালীর জন্মহারের সংকটকে পিতৃতান্ত্রিক লেন্স দিকে দেখে থাকেন এবং মনে করেন যে, মহিলারা যদি সন্তান লালন-পালনের জন্য বাড়িতে অবস্থান করেন তাহলে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের জন্য সেটাই বেশি উত্তম। রোমের লা স্যাফিয়েনজা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আজুরা রিনালডির ভাষায়, প্রধানমন্ত্রী মিলোনির সরকার পরিবার ও পারিবারিক মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক কথা বলেন, মা হবার জন্য মহিলাদের অনুপ্রেরণা দেন, কিন্তু তাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো কথা বলেন না। এ থেকে পরিষ্কার যে, সরকারের মুখ্য কাজ হচ্ছে মায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি। বেশি বেশি মহিলা মা হলে তাদের সন্তান সংখ্যা তথা সামগ্রিকভাবে দেশটির জনসংখ্যাও বাড়বে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরের সময়টা ছিল ইতালীর অর্থনীতির সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির সময়। ঐ সময়টা তাদের সর্বোচ্চ জন্মহারের সময়ও। তখন তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.১ শতাংশ। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। ঐ সময়ে ইতালীতে মোট ১০ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল। কিন্তু এই হার বজায় রাখা যায়নি। কেননা অধিক সংখ্যক হারে মহিলারা বিয়ে করতে অথবা সন্তান ধারণে বিলম্ব করতে থাকেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে প্রথাও ভেঙ্গে যায় এবং ছেলেমেয়েরা তার পরিবর্তে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ও লিভ টুগেদার সংস্কৃতি চালু করে। এটা ছিল সত্তুরের দশকের প্রবণতা। রোমের লুই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা জনসংখ্যাবিদ মাবিয়া রিতা টেস্টার ভাষায় এই সময় মহিলাদের প্রধান প্রবণতা ছিল শ্রম বাজারে প্রথম নিজেদের অবস্থান সংহত করা ও পরে পারিবারিক জীবন শুরু করা। ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে সুইডেন, জার্মানি ও ফ্রান্স এই ধরনের যে কাজটি করেছে তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্তানের দেখাশোনা ও লালন-পালনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া, মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থান সহজীকরণ এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে লৈঙ্গিক সমতা বিধান। অর্থনীতিবিদ রিনালদির মতে, এতে চমৎকার ফল পাওয়া গেছে; মেয়েদের একদিকে কর্মসংস্থান বেড়েছে, অন্যদিকে তারা সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের দিকে মনোযোগী হয়েছে। এটি একটি Vicious cycle-এর মতো। 

আজকের ইউরোপে মেয়েদের সন্তান ধারণের হার তাদের কর্মসংস্থানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কেননা তাদের একজনের আয়ে সন্তান-সন্ততিসহ পরিবারের সকলো ব্যয় নির্বাহ করা খুবই কঠিন। মহিলাদের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কর্মসংস্থানের দিক থেকে ইতালীর মহিলাদের অবস্থানই সবচাইতে নিচে তাদের কর্মক্ষম মহিলাদের মাত্র ৫২ শতাংশ চাকরি করে, জার্মানির তুলনায় এই হার ২০ শতাংশ কম। ইতালীবাসী মনে করে যে, বাচ্চাদের ৬ বছর বয়স হলে স্কুলে ভর্তি করা দরকার এবং সে পর্যন্ত মায়েদের সাথেই তাদের বাড়িতে থাকতে হবে। ধারণার প্রভাব জনসংখ্যার উপর বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে; ১৯৮০-এর দশকে যে সমস্ত মহিলার জন্ম তাদের শতকরা ২২ ভাগের কোনো সন্তান নেই, তারা সন্তান নেয়নি, ফ্রান্সে এই বয়সের ১৫ শতাংশ মহিলার সন্তান নেই। এ ক্ষেত্রে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ইতালী কিছুই করেনি, ‘লুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টেস্টা বলেন, ‘মহিলারা এ ব্যাপারে বাইরের যে সাহায্য পেয়েছে তা হচ্ছে তাদের মা-বাবা ও শ্বশুর-শাশুড়ির তরফ থেকে,’ আজকে সরকার পরিচালিত নার্সারি বা শিশু সদনসমূহে স্থান সংকুলানের অভাব প্রকট, অন্যদিকে বেসরকারি নার্সারিগুলো এতই ব্যয়বহুল যে, মেয়েদের আয়ের বৃহদাংশই এতে চলে যায়, সংসার চালানোর ন্যায় অর্থ আর অবশিষ্ট থাকে না। ১১ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক স্কুলে যাবার বয়স। দুপুর ১টায় তাদের স্কুল ছুটি হয়। দুপুরে খাবার-দাবারের জন্য অধিকাংশ স্কুলে কোনো ক্যান্টিন থাকে না, ছুটির পর ক্লাস-উত্তর কোনো কর্মকা-ও থাকে না। এর সবকিছুই গড়ে তোলা হয়েছে এই ধারণাকে সামনে রেখে যে, মায়েরা বাসায় আছেন, কাজেই তারাই সবকিছু দেখাশোনা করবেন।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের মহিলা কর্মচারীরা যে বেতন পান ইতালীর মহিলারা তার প্রায় অর্ধেক পান। তথাপি এই দেশটির মায়েদের হয় চাকরি ছাড়তে হয় অথবা বাধ্য হয়ে খণ্ডকালীন চাকরি অথবা স্বল্পকালীন চুক্তিভিত্তিক কাজে যোগ দিতে হয়। প্রথম সন্তান জন্মের ১৫ বছর পর কর্মজীবী মায়েরা তাদের সমান যোগ্যতা, বয়স ও দক্ষতাসম্পন্ন সন্তানহীন মহিলাদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক বেতন সুযোগ-সুবিধা পান বলে ব্যাংক অব ইতালীর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ডা. গারবাসীর মতে, তার পিতামাতার দুই সন্তান ছিল। ফলে তারা চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রী মিলোনী দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন যে, বহু মহিলা আছেন যারা মাতৃত্বের অভিশাপ পূরণ করার জন্য ক্যারিয়ার ছাড়তে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রী জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বালি দ্বীপে গিয়েছিলেন এবং তার শিশুকন্যা জিনেবরাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, এর ফলে নারীবাদী নেত্রীরা তার উপর চটে যান। তারা প্রশ্ন করেন যে, প্রধানমন্ত্রীকে কেন দেখাশোনার জন্য তার শিশু কন্যাকে বিদেশে নিয়ে যেতে হবে? শিশুটির পিতা কি তার দায়িত্ব নিতে পারতেন না।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, মা হিসেবে সন্তানকে তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত না করে জাতির জন্য সবকিছু করার তার অধিকার রয়েছে। ইতালীর মহিলাদের মাতৃত্ব এবং সন্তান ধারণের বিষয়টি অধুনা তাদের জাতীয় জীবনে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। No country for mothers’ শীর্ষক সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইতে ইতালীর মহিলার অর্থনৈতিক অবস্থা ও ভবিষ্যতের উপর মাতৃত্বের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। একইভাবে পাডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেমোগ্রাফি বিভাগের একটি সাময়িকীতে “The children I do not want” শীর্ষক এক নিবন্ধে রোসেলা (Roccella) নামক ৬৯ বছর বয়সী এক নারী নেত্রী সন্তান ধারণ ও নিঃসন্তান থাকার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেছেন যে, ইতালীর নারীদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানো প্রয়োজন। তার মতে ‘‘আমরা আমাদের জামানায় বহুমুখী কাজকর্ম করেছি। সন্তান ধারণ, লালন-পালন ও সংস্কারের কাজও করেছি। এখনকার মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, সঙ্গত কারণে তারা চায় না যে, ছেলেরা যা করে তার দ্বিগুণ কাজ তারা করুক। আমাদের মতো ত্যাগ স্বীকারে তারা রাজি নয়। শুধু ইতালী নয়, সারা পাশ্চাত্য বিশ্বের অবস্থাই এখন একই। মেয়েরা মা হতে চান না। বিয়ে করতে চান না, লিভ টুগেদার বিয়ের বিকল্প হয়ে পড়েছে।” তারা মা হতে চান না, মায়ের দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করছেন। ফলে জনসংখ্যার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো জনসংখ্যার ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে জনশক্তি আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে। পরবর্তী সংখ্যায় এ ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো। 

https://www.dailysangram.info/post/544239