২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৩:১৯

সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় দুষ্টচক্রের ছায়া

 

দেশের যত জাতীয় চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এর অধিকাংশই রাজধানীর আগারগাঁও এবং শেরেবাংলা নগরে। এর একটি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল)। এ হাসপাতালের একটি প্রভাবশালী দুষ্টচক্রের ১০ থেকে ১২ সদস্যের কাছে জিম্মি চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা। সম্প্রতি এই চক্র আরও বেপরোয়া বলে অভিযোগ উঠেছে। রোগী ভাগিয়ে নেওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জালিয়াতি, আইসিইউ বাণিজ্যসহ তাদের নানা অপকর্মে দিশেহারা মানুষ। প্রান্তিক এলাকা থেকে আসা রোগীর কাছ থেকে চিকিৎসার নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি টাকা। চিকিৎসার নামে প্রতারিত হচ্ছেন কেউ কেউ।

সিন্ডিকেটের এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পঙ্গু হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স আসাদুজ্জামান জুয়েল, জাহাঙ্গীর আলম ও নার্স শরিফ আহমেদ। বহির্বিভাগের ইনচার্জ আলমগীর, সহকারী নার্স আমিরুল ইসলাম। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে কেবিন, ওয়ার্ড, প্যাথলজি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটারসহ পুরো বহির্বিভাগ এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। 

গত ২ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ রংপুর শাখার পরিচালক শাহেদুর রহমান তাঁর ভাই কামরুজ্জামানকে নিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে আসেন। সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যাওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে আনা হয়। টিকিট কিনতে গেলে কাউন্টারে কর্তব্যরত ব্যক্তি জরুরি বিভাগের সিনিয়র স্টাফ নার্স আসাদুজ্জামান জুয়েলের অনুমতি নিতে বলেন। জুয়েল রোগীর অবস্থা জেনে বলেন, এ রোগীর চিকিৎসা এখানে হবে না, বেসরকারিতে নিতে হবে। অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করলে পা কেটে ফেলতে হবে। 

শাহেদুর রহমান বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য আমাদের নেই। তখন জুয়েল রাগান্বিত হয়ে বলেন, আমার কিছু করার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর সিন্ডিকেটের ৮ থেকে ১০ সদস্য জোর করে বেসরকারি টেককেয়ার হাসপাতালে নিতে চেষ্টা করেন। পরে রোগীর পরিচিত ওই হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. সঞ্জয় কুমার ঘোষকে ফোন করে জরুরি বিভাগে ডেকে আনেন। চিকিৎসক দেখে তারা রোগীকে টিকিট দেন। তখন ডা. সঞ্জয় চিৎকার করে বলেন, ‘এখন কীভাবে টিকিট দিলেন।’ এ সময় নার্সদের সঙ্গে চিকিৎসকের হাতাহাতি হয়। পরে বেলা ১১টার দিকে রোগী কামরুজ্জামানকে হাসপাতালের নীল ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

তবে জরুরি বিভাগের নার্স শরিফ আহমেদ বলেন, কামরুজ্জামানের ভর্তির জন্য টিকিট চাইলে আমরা স্বজনের কাছে প্রশ্ন করে জানতে পারি রোগীর পায়ের সমস্যা কয়েক দিন আগের। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে অনুরোধ করি। পরে ডা. সঞ্জয় কুমার ঘোষ টিকিট দিতে বললে দিয়ে দিই। তবু ডা. সঞ্জয় হুমকি-ধমকি দেন।

দুই সপ্তাহ পর অধ্যাপক ডা. ওয়াহিদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে  কামরুজ্জামানের পায়ের অস্ত্রোপচার করা হয়। স্বজনের অভিযোগ, দ্রুত চিকিৎসা না পাওয়ায় কামরুজ্জামানের পা কেটে ফেলতে হয়।

অধ্যাপক ওয়াহিদুর রহমান বলেন, রোগীর স্বজনের অভিযোগ ঠিক নয়। এ হাসপাতালে আসার আগে রংপুরে তিন দিন রোগী ভর্তি ছিলেন। তাছাড়া কোনো রোগীর পা কেটে ফেলতে হলে অন্য চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ লাগে। একদল চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণের পর পা কাটার সিদ্ধান্ত হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ অনিয়মের বিরুদ্ধে হাসপাতালের পরিচালকের কাছে অভিযোগ করেন কামরুজ্জামানের পরিবার। তবে এখনও কোনো প্রতিকার মেলেনি। পরে গত ১১ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণলয়ে সিনিয়র স্টাফ নার্স আসাদুজ্জামান জুয়েলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করা হয়। এই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এমনকি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই চিঠি ১১ ডিসেম্বর অধিদপ্তরে পৌঁছে। এরই মধ্যে ১৩ দিন পার হলেও ব্যবস্থা নেয়নি নার্সিং অধিদপ্তর।

একই অবস্থা মানিকগঞ্জের বাসিন্দা সাইফুল ইসলামের। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে এক মাস আগে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হন। পায়ে দ্রুত অস্ত্রোপচার জরুরি, তবে এখনও সিরিয়াল মিলছে না। তাঁর পায়ের অবস্থা জানতে চিকিৎসক ছয়টি পরীক্ষা দিয়েছেন, এর চারটিই বাইরের ক্লিনিকে করতে বলা হয়েছে। সাইফুল ইসলাম বলেন, এই হাসপাতালে গরিবের কোনো চিকিৎসা নেই। পুরোটাই দালাল সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। চিকিৎসাসেবার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে প্রতিদিনই ভোগান্তির মুখোমুখি হচ্ছেন রোগী। পঙ্গু হাসপাতালে টাকা ছাড়া ওয়ার্ডবয় ও আয়াদের কাছ থেকে ন্যূনতম সেবা পান না কোনো রোগী, এমন অভিযোগ অনেকের।

এই হাসপাতালে দীর্ঘদিন বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিরা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। দুই বছর পরপর এ দায়িত্ব পরিবর্তনের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না। এমনকি কেউ কেউ প্রায় দুই দশক ধরে পদে বহাল রয়েছেন। তেমনই একজন বহির্বিভাগের ইনচার্জ আলমগীর হোসেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের বহির্বিভাগে বর্তমানে ১৫ জন নার্স কাজ করেন। বিনামূল্যে সেবার জন্য রোগীর কাছ থেকে যে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে তা থেকে প্রত্যেক নার্সকে দৈনিক ১ হাজার টাকা করে আলমগীর হোসেনকে দিতে হয়। এ ছাড়া তিনি নিজে রোগীদের পায়ে ইমপ্লান্ট করেন। এ সেবা বিনামূল্যে দিচ্ছে সরকার। তবে তিনি প্রতিটি রোগীর কাছ থেকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা নেন। বহির্বিভাগে দৈনিক পাঁচ থেকে ছয় রোগীর পায়ের ইমপ্লান্ট করা হয়। সব মিলিয়ে দৈনিক আলমগীর হোসেনের উপরি আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তবে কর্তৃপক্ষ নিয়ম না মেনে টানা চার বছর তাঁকে বহির্বিভাগের ইনচার্জের দায়িত্বে রেখেছে।

বহির্বিভাগের ইনচার্জ আলমগীর বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। তাহলে দৈনিক ১ হাজার টাকা দিচ্ছেন, তিন নার্স আপনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছে কেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, কে অভিযোগ করেছে, আমার জানা নেই। আমি এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত নই।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাকসুরা নূর বলেন, এমন অনেক অভিযোগ আসে অধিদপ্তরে। আসাদুজ্জামান জুয়েলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এসেছে কিনা, তা দেখে বলতে হবে। তবে এমন অভিযোগ এলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, অবৈধ হাসপাতাল বন্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালে সেবার মান বাড়াতে কাজ চলছে। কোনো অবস্থাতেই রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করার সুযোগ দেওয়া হবে না।