২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৩:১১

গত ভোটের মোট খরচের প্রায় দ্বিগুণ ব্যয় আইনশৃঙ্খলায়

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সময়কার ব্যয় মেটাতে নির্বাচন কমিশনের কাছে ১ হাজার ২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা চেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী। যা পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মোট খরচের প্রায় দ্বিগুণ। আর আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি। অর্থাৎ আসন্ন নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা খাতে। এদিকে বিশাল বাজেটের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২৭৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। যার মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা কার্যক্রমে ব্যয় হবে ১০৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। একক হিসাবে প্রতিটি আসনের নির্বাচন আয়োজন করতে ইসি’র ব্যয় হচ্ছে ৭ কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার টাকা। ফলে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যয়ের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। 

 

তবে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য খাতে এত টাকা খরচ হওয়া উচিত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে যেখানে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল সেখানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শুধু আইনশৃঙ্খলা খাতেই ১২২৫ কোটি টাকার বিশাল ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তারা।

ইসি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৭০০ কোটি টাকা। যদিও পরে তা বেড়েছিল।

এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খরচ হয় প্রায় তিনশ কোটি টাকা। 
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এবার নির্বাচনে জ্বালানি তেলের দাম, ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যা বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিসহ কয়েকটি কারণে খরচ বাড়ছে।

ইসি’র কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী ২০টি অর্থনৈতিক কোড থেকে নির্বাচনের সামগ্রিক ব্যয়ের টাকা ছাড় করে থাকে নির্বাচন কমিশন। ইসি’র প্রস্তাবিত বাজেটে ওই ২০টি অর্থনৈতিক কোডের ১৭টিতেই ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একটিতে ব্যয় কমানো ও দুটিতে বিদ্যমান বাজেট বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ২০টি অর্থনৈতিক কোডের মধ্যে সম্মানী খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। চলতি বছরের বাকি ৬ মাসের জন্য এ খাতে ইসি ব্যয় ধরেছে ১১৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ইসি এ কোডেই ৬৬৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করেছে। সম্মানী খাতের ১১৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা জাতীয় ও উপজেলা নির্বাচনে ব্যয় হবে। চলতি অর্থবছরে অন্যান্য যেসব নির্বাচন বা উপনির্বাচন হবে সেখানকার ব্যয়ও এ খাত থেকে বহন করবে ইসি।

নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে খোরাকি ভাতা পান বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সহায়ক ও পেশকাররা। তাদের খোরাকি ভাতাও বাড়ানো হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচনী মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদেরও আগের চেয়ে বেশিদিন রাখা হবে। ভোটকেন্দ্র বাড়ায় তাদের বেশি সংখ্যক সদস্যও মোতায়েন করতে হবে। চলতি অর্থবছরে বাকি সময়ের জন্য খোরাকি ভাতা খাতে ৬৪৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা ধরেছে নির্বাচন কমিশন। ইসি এ কোডেই ৪৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এ ছাড়া যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত যানবাহন খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ২২৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা করেছে। 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনসার সদস্যদের আপ্যায়ন ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে। রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কার্যালয় ও সংস্থার আপ্যায়ন ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এই খাতে ৩৯৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয় ধরেছে ইসি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি ও যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিবেচনায় এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি অর্থবছরে অন্যান্য মনিহারি খাতে ৩১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। একইভাবে প্রচার ও বিজ্ঞাপন কোডে ৯৫ কোটি ১২ লাখ টাকা, ব্যবস্থাপনা ব্যয় কোডে ২৩৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা, পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট কোডে ২১৭ কোটি ২১ লাখ টাকা চেয়েছে নির্বাচন কমিশন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেহেতু এবার বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না সেহেতু এবার আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য খাতে কম ব্যয় হওয়ার কথা। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ২০১৪ সালে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় সেই নির্বাচনে কম খরচ হয়েছিল। তবে ২০১৮ সালে সকল দল অংশ নেয়ার কারণে খরচ বেড়েছিল। মূল্যস্ফীতির কারণে কিছুটা ব্যয় বাড়তে পারে, তবে এত টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়। আমি এত টাকা ব্যয় হওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। 

আগের নির্বাচনগুলোতে যত ব্যয় হয়েছিল: বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ৩০শে ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য মোট ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। পরে তা কিছুটা বেড়েছিল। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির ভোটে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৬৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এরমধ্যে নির্বাচন পরিচালনায় ৮১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয় হয় ১৮৩ কোটি টাকা। এ নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট হয়, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন একক প্রার্থীরা। অর্ধেক এলাকায় ভোট করতে হওয়ায় বরাদ্দের তুলনায় খরচ অনেক কমে আসে। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়; যাতে ভোটার ছিল ৮ কোটি ১০ লাখের বেশি। উপকরণ ও ব্যবস্থাপনাসহ সব খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে ধীরে ধীরে নির্বাচনী বরাদ্দও বাড়ে। এ ছাড়া অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা, সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ১১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে ৩৭ কোটি টাকা, পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ২৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা, তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা, দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ ৩ কোটি ৫২ লাখ ৫ হাজার ৬৪২ জন ভোটারের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ৮১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

https://mzamin.com/news.php?news=89939