২২ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৮:৫২

রাষ্ট্র, রাষ্ট্রাচার ও নির্বাচন

-ইবনে নূরুল হুদা

 

রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠন বা কাঠামোকে বোঝায় যা কোন একটি ভৌগোলিক এলাকা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে। মূলত, রাষ্ট্র একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। ম্যাক্স ওয়েবারের প্রভাব বিস্তারকারী সংজ্ঞানুযায়ী রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক সংগঠন যা নির্দিষ্ট ভূখ-ে আইনানুগ বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে, যাদের মধ্যে রয়েছে সশস্ত্রবাহিনী, নাগরিক, সমাজ, আমলাতন্ত্র, আদালত এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় রাষ্ট্রের অঙ্গ তিনটি। নির্বাহী তথা শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের মূল কাজ আইন অনুযায়ী শাসনকাজ পরিচালনা করা। আইন বিভাগের কর্তব্য নতুন আইন প্রণয়ন ও পুরাতন আইন সংশোধন। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে সুবিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের চেয়ে নির্বাহী বিভাগের কর্মপরিধি ও ক্ষমতা বিস্তৃত। তাই অপরাপর সকল বিভাগের উপরই নির্বাহী বিভাগ কর্তৃত্বশীল। তবে তা সুনিয়ন্ত্রিত ও সংবিধিবদ্ধ। রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের সুসমন্বিত কার্যক্রমই সুশাসনের চালিকা শক্তি। এসব রাষ্ট্রাচারের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

সার্বিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে গ্রাম পুলিশ পর্যন্ত সকলেই নির্বাহী বিভাগের আওতাভুক্ত। সাধারণভাবে রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধানকে কেন্দ্র করে যে বিভাগ গড়ে ওঠে তাকেই এক কথায় নির্বাহী বিভাগ বলা হয়। নির্বাহী বিভাগের মধ্যমণি হচ্ছে ব্যুরোক্রেসী বা আমলাতন্ত্র। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র সত্ত্বা হলেও সেগুলো একে অপরের পরিপূরক। তবে নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রের অপরাপর বিভাগের ওপর সংবিধিবদ্ধ পরিসরে কর্তৃত্বশীল। 

অধ্যাপক গার্নারের মতে, নির্বাহী বিভাগের কার্যাবলীকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। (এক) অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বিষয়ক (Administrative), (দুই) পররাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও বৈদেশিক সম্পর্ক (Diplomatic), (তিন) সামরিক ব্যবস্থা (Military), (চার) বিচার বিষয়ক ক্ষমতা (Judicial) ও (পাঁচ) আইন বিষয়ক ক্ষমতা (Legislative)। নির্বাহী তথা শাসন বিভাগকে সফল ও সার্থক করে তুলতে হলে উপর্য্ক্তু সকল উপবিভাগের একটি কার্যকর সেতুবন্ধন জরুরি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের যেমন সক্রিয়তা দরকার ঠিক তেমনিভাবে নাগরিকদেরও হতে হবে দায়িত্বশীল। 

সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদে সুনাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘It is the duty of every citizen to observe the Constitution and the laws, to maintain discipline, to perform public duties and to protect public property.’ অর্থাৎ ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য’। তাই দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র, রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে স্ব স্ব অবস্থান থেকে দায়িত্ববান হতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থাটা খুবই ভঙ্গুর। বিশেষ করে আমাদের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে।

সুশাসনের ধারণা থেকেই রাষ্ট্র নামক সংগঠনের উৎপত্তি। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুশাসন সর্বব্যাপী হয়ে উঠেনি বা প্রশ্নাতীত হয়নি। আমাদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের যে তীব্রতাটা আরও বেশি। এক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হলো দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা ও স্বেচ্ছাচরিতা। এজন্য অনাধিকারচর্চাও কম দায়ী নয়। সুশাসন ব্যহত হওয়ার জন্য এ দু’টোই অতি উল্লেখযোগ্য কারণ। তবে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাকেন্দ্রীকতা, আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ চর্চার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকেও দায়ী করা যুক্তিযুক্তই মনে হচ্ছে। আর এর প্রভাব আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বত্রই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। বিশেষ করে আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা কোনভাবেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে নির্বাচনের নামে চর দখলের মহড়ার অভিযোগ উঠেছে বেশ জোরেসোরেই। তাই আমাদের দেশে সুশাসন নিয়ে প্রশ্নটাও বেশ তীব্রতা পেয়েছে। বিচ্যুতি ঘটেছে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের।

সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন আরও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে বিগত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এক্ষেত্রে আমাদের সকল পক্ষেরই কমবেশি ব্যর্থতা রয়েছে। কারণ, সরকার, রাজনৈতিক শক্তি, রাষ্ট্রযন্ত্র, সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও নাগরিক সমাজ যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারতো তাহলে এসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে এমন অনাকাঙ্খিত প্রশ্নের সৃষ্টি হতো না। নির্বাচন নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুললেও এক্ষেত্রে যাদের জন্য নির্বাচন তথা নির্বাচকম-লী কিন্তু সন্তষ্ট হতে পারেনি। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এটিই হচ্ছে প্রধান দুর্বলতা ও নেতিবাচক দিক। দেশী-বিদেশী নির্বাচন পর্যক্ষেকরা এসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিরোধী দলগুলোও এসব নির্বাচনকে ‘জনগণের সাথে নির্মম প্রহসন’ হিসেবেই দেখছে। এজন্য বিরোধীদলসহ প্রায় সকল মহল থেকেই নির্বাহী বিভাগ তথা প্রশাসনকে দায়ী করা হয়েছে। বিরোধীদলের পক্ষে বলা হয়েছে, ‘একটি স্বাধীন দেশের প্রশাসন এমন হতে পারে না’। এতে আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র বা জনপ্রশাসনের সম্মান বৃদ্ধি করেনি বরং তাদের বিরুদ্ধে পেশাদারিত্বের অভাব ও দলবাজীর অভিযোগ উঠেছে বেশ জোরালোভাবেই। ফলে রাষ্ট্রাচারেও বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটেছে।

ঔপনিবেশিক আমলের আমলাতন্ত্রে সিভিল সোসাইটি ও জনগণের কাছে কোন জবাবদিহিতা ছিল না। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল স্বাধীন পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রেও। সঙ্গত কারণেই সে সময় ‘Civil Service’ কে ‘Cattle Sevice’ হিসেবে কেউ কেউ ব্যঙ্গ করতেন বলে একজন সিনিয়র আমলার আত্মস্বীকৃতি রয়েছে। বৃটিশ ও ভারতের অভিজ্ঞতায় পাকিস্তানের সেই আমলারা ছিল এলিট শ্রেণির এবং রাজনীতিবিদদের চেয়েও অধিক দক্ষ। তা দেশ ও জাতির জন্য অবশ্যই ইতিবাচকই হতে পারতো যদি আমলারা দায়িত্ব পালনে পেশাদারী, আইন, সংবিধান ও গণমানুষের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের উরুণচন্ডী মনোভাব ও এক শ্রেণির আমলাদের দাসপ্রবণ মানসিকতার কারণেই আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। 

একথাও ঠিক যে, নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব করার ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনের কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংবিধানেও ব্যুরোক্রেসিকে কোনো প্রোটেকশন বা গুরুত্ব দেয়া হয় নি বলে দাবি করেন আমলারা। সঙ্গত কারণেই নিরপেক্ষভাবে কাজ করা বা স্বাধীনভাবে মতামত দেয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না বলেও দাবি করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমলাদের অপেশাদারী মনেবৃত্তিকেই দায়ী করা যেতে পারে। তারা পেশাদারিত্ব দিয়েই এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারতেন। কারণ, রাজনৈতিক টোপ, চাপ ও দলবাজি মুক্ত থাকতে না পারলে আমলাদের পুরোপুরি পেশাদারি হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। বাস্তবেও তাই হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। 

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসনকাজে মূল ভূমিকায় থাকেন রাজনীতিকেরা। তবে এর বিভিন্ন স্তরে বিচিত্র ধরনের কাজের জন্য দরকার হয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর। সাধারণ্যে তারা সরকারি কর্মচারীরূপে পরিচিত হলেও আমাদের সংবিধান প্রণেতারা আখ্যায়িত করেছেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বলে। সরকারকে নীতিনির্ধারণে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা এবং সেই নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন তাদের দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমলাদের অপেশাদারি ও দলবাজ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা সম্পর্কে রাষ্ট্র বিজ্ঞানী অগ (Ogg) বলেন, (‘ÔThe body of the civil servants is an expert, professional, non-political, permanent and subordinate staff .’) অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাবৃন্দ হবে সুদক্ষ, পেশাদারী, অধীনস্থ কর্মকর্তা যারা স্থায়ীভাবে চাকরি করেন এবং রাজনীতির সাথে যাদের কোনো সংশ্রব নেই’। 

বস্তুত, নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন, পদোন্নতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিয়োগ গণপ্রশাসনের কার্যকারিতা হ্রাস করে ফেলেছে। একশ্রেণির দলবাজ কর্মকর্তাও এজন্য কম দায়ী নন। আসলে জনপ্রশাসন চাপমুক্ত থেকে পেশাদারিত্ব বাজায় রাখতে পারলে নির্বাচনকালে ‘নির্দলীয়’ সরকারের দাবি নিয়ে কারও আসার প্রয়োজন হতো না। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য, এসব কর্মচারীর একটি অংশ বেশ ইদানিং দলীয় বিবেচনাতেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এমনকি পরোক্ষভাবে দলীয় কার্যক্রমে যোগ দিচ্ছেন। ১৯৯৬ সালের আমলা বিদ্রোহের ঘটনাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এতে ব্যক্তিগতভাবে তারা হয়তো অনেকেই লাভবান হয়েছেন। কিন্তু পরিণতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমলাতন্ত্রের পেশাদারিত্ব। ধ্বংস হয়েছে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। 

আমলাতন্ত্র পেশাদারি হয়ে উঠেনি বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপও পায়নি তা দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘটনা প্রবাহ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ সালের নির্বাচন কোন নির্বাচন হয়নি বরং নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। আর ২০২৪ সালে এসে তা আরো নির্মম পরিহাসে পরিণত হওয়ার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালে নৈশভোটের নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোন মহলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু এবার শুরু হয়েছে বানরের পিঠাভাগের নির্বাচন। নির্বাচনের নামে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে। যদিও নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, তবুও কমিশনের আবশ্যক হয় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সার্বিক সহযোগিতা। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে মূলত মাঠ প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা; বিশেষত পুলিশ প্রশাসন। ১৯৪৭-এর পর থেকে আজ অবধি সময়ান্তরে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে এসেছে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর আইয়ুব খান তার ক্ষমতার বৈধতার জন্য গণভোটসহ সব নির্বাচনে প্রশাসনকে খোলামেলাভাবে ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীতে শুধুমাত্র মাত্রার হেরফের ঘটলেও প্রশাসনকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করা থেকে খুব কম ব্যতিক্রমই দেখা গেছে। আর ২০১৮ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনপ্রশাসনকে যেভাবে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে তা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না।

অভিযোগ রয়েছে, এই নির্বাচনে প্রশাসন শুরু থেকেই বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে বলে জনসাধারণের মধ্যে অভিযোগ বেশ জোরালো। নির্বাচনে যেকোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্ব হবে দৃঢ়তার সঙ্গে আইন ও ন্যায়ের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে এবং কোনো ধরনের অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে দায়িত্ব পালন করা। তারা আইনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন, কোনো ব্যক্তি বা দলকে নয়। শক্তি প্রয়োগে তারা নিষ্ক্রিয়তা কিংবা অতি সক্রিয়তা কোনোটাই দেখানো ঠিক নয়। শান্তিপূর্ণ ও আইনসম্মত প্রতিবাদে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি অযৌক্তিক হবে। গ্রেপ্তার কিংবা শক্তি প্রয়োগের প্রশ্নে তারা কারও ইন্ধনে প্ররোচিত হওয়াও যথোচিত হবে না। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার পুরোপুরি ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে বলে সর্বমহল থেকেই অভিযোগ করা হয়েছে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গণহারে গায়েবী মামলা দেয়া হয়েছে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো দূরের কথা বিরোধী দলীয় প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণার ন্যূনতম সুযোগও পাননি। পক্ষান্তরে সরকার দলীয় প্রার্থীরা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসে নতুন ফিৎনার সৃষ্টি হয়েছে। এবার বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গণগ্রেফতারের পাশাপাশি গণসাজার বিষয়টিও সামনে এসেছে। রাজনৈতিক মামলাগুলোর অতিদ্রুততার সাথে সাজা দিয়ে রাজনৈতিক ময়দানকে প্রতিপক্ষমুক্ত করার অভিযোগ উঠেছে বেশ জোরালোভাবেই।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার অভিযানকে আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দায়িত্ব বলে দাবি করা হলেও নির্বাচনে ভোট চুরি রোধে প্রশাসনের ভূমিকা রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন গর্হিত ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজকে প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার অভিযোগও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিরোধীদলগুলো রাজপথে আন্দোলন করলেও সরকার তা মোটেই আমলে নিচ্ছে না। এমনকি ইতোমধ্যেই সিরিজ কর্মসূচিসহ বিরোধীদলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু জনপ্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার করে বিরোধীদলের যৌক্তিক আন্দোলনকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে দমন করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগটা ক্রমেই তীব্রতা পাচ্ছে। যা সরকারি কর্মচারি বিধিমালা ও সংবিধানের মারাত্মক লঙ্ঘন বলেই বিবেচিত। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘Every person in the service of the republic has a duty to strive at all time to serve the people.’

অর্থাৎ ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’। কিন্তু আমাদের দেশের সিভিল প্রশাসন কি সেই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? উত্তরটা তো ইতিবাচক হওয়ার কোন সুযোগ নেই!

https://www.dailysangram.info/post/543883