২১ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:১৩

প্রস্তাবেই আকাশচুম্বী খরচ

দেশের উন্নয়নে সরকারের নানা প্রকল্প প্রস্তাবে আকাশচুম্বী ব্যয় ধরা হচ্ছে। এতে অনেক প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় বরাদ্দের চেয়ে অস্বাভাবিক ব্যয় অনুমোদন পেয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো প্রকল্পে বিপুল ব্যয় ধরা হলে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করে পরিকল্পনা কমিশন। এর পরও কিছু প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে অনেক সময় ফাঁকফোকর থাকে, যা তাড়াহুড়ার কারণে অনেক সময় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।

এতে সম্ভাব্য ব্যয়ের চেয়ে প্রকল্পে অনেক বেশি ব্যয়ের বিষয়টি অনুমোদন পেয়ে যায়।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, গত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-১। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। প্রকল্পে পাঁচ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোহিতা সংস্থা (জাইকা)।

এই টাকা দিয়ে মাত্র ২৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৩২৯ কোটি টাকা। অথচ এই প্রকল্প যখন পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করা হয়, তখন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২৬ কোটি টাকা।

অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় কমেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, প্রকল্পটির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনা কমিশন তিন হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয় কমানোর নির্দেশ দিয়েছিল। সেই আলোকেই আবার সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে প্রস্তাব করেছে। সেই হিসাবে এই তিন হাজার ৫৮০ কোটি টাকা কমে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্ভব।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্পনা কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি হবে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক।

এর আগে কোনো সড়কে প্রতি কিলোমিটারে এত খরচ হয়নি। এই ২৩ কিলোমিটারের জন্য যে খরচ হচ্ছে, তা দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পুরো সড়কটি করা সম্ভব। তবে কমিশন যাচাই-বাছাই করে অনেক ব্যয় কমিয়ে এনেছে।’

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) তাদের ‘ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির কার্যক্রম ব্যবহারে আইএমইডির সক্ষমতা বৃদ্ধি’ প্রকল্পের সংশোধন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়, যে প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল মাত্র ১৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। বিভিন্ন ধরনের কাজ (এর মধ্যে কিছু অপ্রয়োজনীয় কাজও রয়েছে) যুক্ত করে সেই প্রকল্পের ব্যয় সংশোধন প্রস্তাবে ধরা হয় ৪৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ পরিকল্পনামন্ত্রীর মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়ার জন্য প্রস্তাবিত সর্বোচ্চ ব্যয়। পরিকল্পনামন্ত্রী ৫০ কোটি টাকার কম ব্যয়ের প্রকল্পগুলো নিজেই অনুমোদন দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একনেকে তোলার প্রয়োজন পড়ে না।

প্রকল্পটির প্রস্তাবে দেখা যায়, আইএমইডির জনবল যেখানে মাত্র ১৩০ জন, সেখানে ১৪৪ জন কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। মূল প্রকল্পে ৪০ জন কর্মকর্তার বৈধ প্রশিক্ষণের সংস্থান ছিল, যেখানে এডিপিতে এক হাজার ৫০০ প্রকল্প চলমান রয়েছে, সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নে পাঁচ হাজার ৯০ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া আসবাবসহ বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

তবে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাবগুলো বাদ দিতে বলে পরিকল্পনা কমিশন। পরে প্রকল্পটি ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের অনুমোদন পেয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে এই বিপুল অঙ্কের টাকা অপচয় হতো।

জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পটির প্রস্তাব যখন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়, তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) যাচাই-বাছাই করে অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৫৭৫ কোটি টাকায় কমিয়ে আনে। সেই স্বল্প ব্যয়েই আগের অ্যানালগ পদ্ধতি বাদ দিয়ে এবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্যাবের মাধ্যমে সফল জনশুমারি হয়েছে। এর পরও উদ্বৃত্ত থাকছে প্রকল্পের অর্থ। সেই অর্থ দিয়ে এখন আরো নতুন কাজ যুক্ত করা হচ্ছে। অথচ প্রথম পাঠানো প্রকল্পটির সেই তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রস্তাব অনুমোদন পেলে সেটাই ব্যয় হয়ে যেত।

সম্প্রতি একনেকে অনুমোদন পাওয়া চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ ডুয়াল গেজে রূপান্তর প্রকল্পে বেশি ব্যয় ধরা হয়। ২০১৯ সালে যে প্রকল্পটি মাত্র দুই হাজার ২৫০ কোটি টাকায় বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছিল, এটির ব্যয় এখন প্রায় চার গুণ বাড়িয়ে আট হাজার ৪৩২ কোটি টাকা করা হয়েছে। প্রকল্পটিতে নতুন করে ৩০টি লোকোমোটিভ (রেল ইঞ্জিন) যুক্ত করে ১০ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকায় অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পটিতে রেললাইন স্থাপনে অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় আড়াই থেকে চার গুণ বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। সরকারের শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পিইসি সভার পর নতুন করে প্রকল্পটিতে বড় একটি কেনাকাটা যুক্ত করা হলেও পরে আর কোনো সভা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা প্রকল্পটির বিষয়ে বলেন, ‘এত বেশি ব্যয়ে অনুমোদন পাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছি। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত লিখে দিয়েছেন যে কোন কোন খাতে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। এর পরও কমানো যায়নি।’

এ বিষয়ে রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা সলিমুল্লাহ বাহার কালের কণ্ঠকে বলেন, ডলারের দাম ৮৫ টাকা ধরে আগের প্রকল্পগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন প্রকল্পে প্রতি ডলারের দাম ধরা আছে ১০৯ টাকা। প্রতিটি ডলারের দাম ২৪ টাকা বেড়ে যাওয়ায় আমদানিনির্ভর প্রতিটি উপকরণের দাম বাড়ছে। রেলপথ তৈরির মূল উপকরণ রেলপাত, স্লিপার, পাথরসহ বেশির ভাগ উপকরণই আমদানি করতে হবে। তা ছাড়া কম্পিউটার বেইসড ইন্টারলকিং প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণেও প্রকল্পের ব্যয় বাড়তি মনে হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনাসচিব মামুন-আল-রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক প্রকল্পেই বেশি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। অনেকে জেনেবুঝেই এই কাজ করেন। তবে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পের ব্যয় বিভাজন খুব সূক্ষ্মভাবে দেখে। প্রতিটি প্রকল্পে ব্যয় প্রস্তাবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। যেটা যৌক্তিক, সেটাই দেয়।

তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি দেয় বলেই অনেক প্রকল্প থেকে অতিরিক্ত ব্যয় কমানো যাচ্ছে। তবে যারা অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব করে ফায়দা লুটতে চায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

তবে পরিকল্পনা কমিশনের বর্তমান সচিব সত্যজিত কর্মকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাঁরা প্রকল্প প্রস্তাব করেন, তাঁরা হয়তো আরো ভালো মানের কাজ করাতে চান। তাই বেশি ব্যয় প্রস্তাব দেন। আমরা যাচাই-বাছাই করে যদি দেখি, এই রকম কাজ এখানে দরকার নেই, তখন ব্যয় কমে যায়।’

পরিকল্পনা কমিশনের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা (যাঁরা মূলত প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকেন) কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক দেশেই বেশি ব্যয় প্রস্তাবে শাস্তির বিধান আছে। যদি বেশি ব্যয় প্রস্তাবের জন্য ওই মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প প্রস্তাব পাঁচ বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন দেখা যাবে কোনো মন্ত্রণালয় থেকে আর বেশি ব্যয়ের প্রস্তাব আসবে না। তারাই প্রকল্প একবারে যাচাই-বাছাই করে ফাইনাল করে পাঠাবে। এখন দেখা যায়, সংস্থা যেভাবে পাঠায় সেভাবেই ছেড়ে দেয়। তাই এই বিষয়গুলো আরো শক্ত হাতে দেখা দরকার।

প্রকল্পে বেশি ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর একটি লক্ষ্য থাকে যে তারা বাজেট বেশি প্রস্তাব করলে কমিশন তা কমাবেই। এটা ভেবে তারা অনেক সময় বেশি প্রস্তাব করে। তবে বেশি প্রস্তাব দেওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি বরাদ্দ নেওয়া। যদি বেশি বরাদ্দ নিতে পারে তাহলে দেখা যায়, এখান থেকে একটা ফায়দা হাসিলেরও সুযোগ থাকে তাদের। এগুলো রুখতে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।

প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্প প্রস্তাবগুলো ভালো করে খতিয়ে দেখা দরকার। সেখানে যদি বাজারমূল্যের তুলনায় বেশি দাম ধরা হয়, তাহলে এর পেছনে নিশ্চয়ই অসৎ উদ্দেশ্য আছে। যাঁরা এসব প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত তাঁরা হয়তো যোগসাজশে অর্থ আত্মসাৎ করতেই এ ধরনের ব্যবস্থা রেখেছেন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/12/21/1347547