৯ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৩

মেগাপ্রকল্পে সংশয়

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা সমীকরণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মেগাপ্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মেগাপ্রকল্পগুলোর মধ্যে একমাত্র দৃশ্যমান অগ্রগতিতে থাকা পদ্মা সেতু যে ২০১৮ সালের মধ্যে পুরো শেষ হচ্ছে না- সাম্প্রতিক কাজের অগ্রগতি বিবেচনা করে তাও একপ্রকার নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছেন বিশ্লেষকরা। গত এক বছরে এই প্রকল্পে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। অর্থাৎ, এই গতিতে কাজ চললে পদ্মা সেতু শেষ হতে লাগবে আরও ৫ বছরের বেশি সময়। 

এদিকে ‘অদৃশ্য’ কারণে গত ছয়মাসে চীন প্রকল্প সহায়তার একটি টাকাও ছাড় করেনি যার পেছনে ‘অন্য কিছু’র ইঙ্গিত পাচ্ছেন অনেকে। শ্লথ গতি জাপান ও ভারতের প্রকল্প সহায়তার অর্থ ছাড়েও। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে দিল্লী তৃতীয় ক্রেডিট লাইনের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ক্রেডিট লাইনের প্রকল্পই নির্ধারিত হয়নি। ছাড় হয়নি প্রথম ক্রেডিট লাইনের সব অর্থ। রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে পদ্মা সেতু করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সরকার। ভস্ট্র এ্যাকাউন্ট (বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলার কিনে) থেকে পদ্মা সেতুর ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে দেশে হয়েছে ডলারের সংকট যা হুমকিতে ফেলে দিয়েছে বহিঃবাণিজ্যকে।
এদিকে দেশে এসে গেছে জাতীয় নির্বাচনের আবহ, যে কারণে সরকার চালানোর পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের মাঠের রাজনীতিতেও সময় দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে দিন যত যাচ্ছে, বৃহদাকার প্রকল্পগুলো নিয়ে সংশয় তত ঘনীভূত হচ্ছে।
মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর যতগুলো স্বপ্ন জাগানিয়া বৃহদাকার প্রকল্প হাতে নেয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম পদ্মা বহুমুখী সেতু। নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ১৭ জুন চায়না মেজর ব্রীজের সঙ্গে চুক্তির মধ্য দিয়ে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে এসে ২১ মাসে এই প্রকল্পের অগ্রগতি হয় ৩৩ শতাংশ যেটাকে সন্তোষজনক হিসেবে ধরে নিয়েছিল সরকার। তবে এরপর থেকেই হঠাৎ শ্লথ হয়ে আসে প্রকল্পে কাজের গতি। গতবছরের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ মাসে কাজের অগ্রগতি হয় মাত্র ৭ শতাংশ। আর গত চার মাসে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) ২৯ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২ ভাগ। সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় যে হিসাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, তাতে এখন পর্যন্ত ৪২ ভাগ কাজ শেষ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
বর্তমান সরকার যে করেই হোক ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করতে চাইলেও হঠাৎ কাজে কেন ধীর গতি- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরও তীক্ত তথ্য। ঋণচুক্তি হওয়ার পরও চীন গত ছয় মাস ধরে কোন প্রকল্পেই অর্থছাড় করেনি। এছাড়া যেসব প্রকল্পে অর্থায়নের আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট সেগুলোর বিষয়েও এক ইঞ্চি আগাচ্ছেনা দেশটি।
গত অক্টোবরে ঢাকা সফর করে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২ হাজার ৪শ কোটি ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে তিনটি প্রকল্পে ঋণচুক্তিও সই হয়েছিল। এর বাইরে আরও তিন প্রকল্পে ঋণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে গত ছয় মাসে কোন ঋণচুক্তিই কার্যকর হয়নি। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কর্নফুলি টানেল, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মতো ফাস্টট্রাকে থাকা মেগাপ্রকল্পগুলো। কর্নফুটি টানেলে অর্থায়নের চুক্তি করলেও এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পে অর্থছাড় করেনি চীন। আর ৩৪ হাজার কোটি টাকার পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত চুক্তির দিকেই আগায়নি দেশটি।
সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বোঝা যাচ্ছে, দেশের মেগাপ্রকল্পগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি। এতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে, তেমনি সুযোগের সদ্ব্যাবহার করতে না পারায় ঝুলে যাচ্ছে প্রকল্পগুলো।
দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়ে চীনের আচরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের পর দেশটি নজর দিয়েছে বাংলাদেশের দিকে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশ সফর করেন। গত ২৮ বছরে এটাই ছিল প্রথম কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। এই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে লেখা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশে নয়াদিল্লির প্রভাব কমাতে চীনা প্রেসিডেন্টের সফর।’ এই সফরের সময় দেশ দুটির মধ্যে ২৭টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন চীন বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দেয় যাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিশ্লেষকরা ‘চেকবুক কূটনীতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। স্বাভাবিকভাবে কোন দেশে বড় বিনিয়োগ মানে সেখানে বাণিজ্য স্বার্থ নিশ্চিত করার বিষয় থাকে। থাকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়।
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে ৪৭তম অর্থনীতির বাংলাদেশকে কাছে টানতে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন ২৪ বিলিয়ন ডলারের ‘চেকবুক কূটনীতি’ ব্যবহার করলেও ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে’ হঠাৎ সময়ক্ষেপণ শুরু করে। তবে এতে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব কমার কোন কারণ দেখছেন না বিশ্লেষকরা। কারণ, চীনের ‘চেকবুক কূটনীতি’ টেক্কা দেয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা ভারতের নেই- এমন মত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর পলিসির সিনিয়র গবেষক আভিয়া নাহরিনের।
বাংলাদেশের বিষয়ে চীনের এই আগ্রহে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল নয়াদিল্লী। ভারতের প্রতিক্রিয়ায় বেইজিংও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়, যদিও দেশটির দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক বৈশিষ্ট্যই হলো দেরিতে প্রতিক্রিয়া দেখানো।
চীন ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চাইলেও ‘অজানা কারণে’ এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৪ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে গেলে ৫০ হাজার কোটি টাকার সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে চুক্তির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও পারেনি বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছিল, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিরোধীতার কারণে শেষ পর্যন্ত চুক্তি থেকে সরে আসে বাংলাদেশ। এই প্রকল্পটি ফাস্টট্রাকের আওতাভুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত অর্থায়নের বিষয়ে কোন সুরাহা হয়নি।
এদিকে চীনের হঠাৎ সময়ক্ষেপণের পেছনে ‘অন্য’ কারণ দেখছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একজন সিনিয়র কর্মকর্তা যিনি নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, “চীন বর্তমানে মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। পাশাপাশি দেশটি সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে চাচ্ছে। ১১ তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে খুব বড় বিনিয়োগে আর দেশটি যাচ্ছে না। পাশাপাশি চলমান প্রকল্পগুলোও যত দীর্ঘায়িত হবে দেশটির লাভ তত বাড়বে। কারণ এতে অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে নিতে পারবে দেশটি, যেটা করেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন প্রকল্পে।”
মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি :
বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা বৃহদাকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস টার্মিনাল (এলএনজি) নির্মাণ। সরকারের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পদ্মা সেতুতে।
পদ্মা সেতুর কাজে অগ্রগতি হলেও শুরু করা যায়নি রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ। এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত অর্থায়নই নিশ্চিত হয়নি যদিও চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ আছে ৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা; যার মধ্যে মাত্র ৪ কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পে আগামি অর্থবছরেও বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার ৬৩ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে মেট্রোরেলের একাংশ ও ২০২২ সালে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়নি। মাত্র প্রকল্পের আটটি প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে মিরপুরে সেবা লাইনগুলো সরানোর কাজ। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার জাপানী অর্থায়নের এই প্রকল্পও চলছে শম্বুক গতিতে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মানের প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি। অথচ ২০১৮ সালের মধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়ার অর্থায়নের চুক্তি থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়নি। ১ লাখ সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে সরকার এ পর্যন্ত ব্যয় করতে পেরেছে মাত্র ৪শ কোটি টাকা।
প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পে জাপানের অর্থায়নের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত স্থগিত আছে দরপত্র গ্রহণের কার্যক্রম। এ প্রকল্পের বিষয়ে কয়েকমাস আগে জাপানি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, মাতারবাড়ি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে না জাপান। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, প্রক্রিয়া স্থগিত আছে, বাতিল হয়নি। অর্থাৎ এই প্রকল্পটি এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।
সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এখন পর্যন্ত ৪২০ একর জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। ফেন্সিং শেষে বর্তমানে সাইট অফিস নির্মাণের কাজ চলছে।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, অফিস ভবন নির্মাণ, ড্রেজিং কার্যক্রমসহ বেশকিছু কাজ শেষ হয়েছে।
১৮ হাজার কোটি টাকার দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের শুধু জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে।
মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, “বাংলাদেশের সব প্রকল্পের কাজেই দেরি হয়। এক বছরের কাজ শেষ করতে চার বছর লাগানো হয়। এতে একদিকে যেমন ব্যয় বাড়ে, তেমনি প্রকল্পের সুফল পেতেও দেরি হয়। এতে অর্থায়নকারী ও সরকার- উভয়েই ক্ষতির মুখে পড়ে।”

https://www.dailyinqilab.com/article/78792/