৯ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩১

পরবর্তী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে চায় ইইউ

২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির বহুল আলোচিত ‘একতরফা’ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দল পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে বলে মনে করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আগামীতে অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব রাজনৈতিক পক্ষের সহায়ক ভূমিকা থাকবে বলেও আশাবাদী ইউরোপের ২৮ রাষ্ট্রের ওই জোটের বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়েদুন। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সমপ্রদায় প্রতিষ্ঠার ভিত্তিমূল ‘ট্রিটি অব রোম’-এর ৬০তম বার্ষিকীর ঢাকার আয়োজনকে সামনে রেখে গতকাল গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের (স্বল্প সংখ্যক) সঙ্গে আলাপে ইইউ’র এ আগ্রহের কথা জানান তিনি। গুলশানস্থ ইইউ ডেলিগেশন কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন ছাড়াও রাষ্ট্রদূত মায়েদুন ফ্রান্সের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন, বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক, পোশাকশিল্প পরিস্থিতি, সরকার-হেফাজত সম্পৃক্ততা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। ঢাকায় ৩ বছরের এসাইনমেন্ট শেষে আগামী আগস্টে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণকারী পিয়েরে মায়েদুন আশা করেন বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের মতামতের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটবে। বিশ্বের যে কোনো স্থানে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের ঘাটতির কারণে রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয় এমন মন্তব্য করে রাষ্ট্রদূত মায়েদুন বলেন, বন্ধু এবং উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে আমরা (ইইউ) তোমাদের দেশে (বাংলাদেশ) এমন পরিস্থিতি অবশ্যই দেখতে চাই না। তিনি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, এখানে এমন পরিস্থিতি হবে না। রাষ্ট্রদূত এ-ও বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে উৎসাহিত এবং সহযোগিতা করার বিষয়ে (প্রমোট) ইউরোপীয় ইউনিয়নের সার্বজনীন এজেন্ডা রয়েছে। ইইউ’র এজেন্ডার বিষয়ে বাংলাদেশে সচেতন থাকবে বলেও আশা করেন তিনি। জাতীয় পার্টি (এরশাদ)-এর নেতৃত্বাধীন ৫৮ দলের নবগঠিত জোটের বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি রাজনীতির ‘অন্তর্ভুক্তি’র এ উদ্যোগকে অন্য অনেক পদক্ষেপের মতো ইতিবাচক হিসাবেই দেখেন। দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা সঙ্কটের স্থায়ী এবং কার্যকর সমাধানে সাম্প্রতিক সময়ে চীন যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশকে সহযোগিতায় তারা যেভাবে এগিয়ে এসেছে তা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, অন্য অনেকের মত চীনও এখন এ বিষয়ে কথা বলছে। এটি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। চীন ইইউ’র কৌশলগত অংশীদার উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে ইইউ তার ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। বৈশ্বিক এবং মানবিক সঙ্কট হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুর একটি সমাধানে পৌঁছাতে আমরা শুধু কথা বলি না, কাজ করি। বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের সামগ্রিক উন্নয়নে ইইউ এবং আইএলও নির্দেশিত ‘সাসটেইনিবিলিটি কমপেক্ট’ এর পরবর্তী (আগামী সপ্তাহে) বৈঠক প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, এ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ চমৎকার অগ্রগতি করেছে। আরও কি কি কাজ করার প্রয়োজন তা নিয়ে আগামী সপ্তাহে রিভিউ বা পর্যালোচনা বৈঠক হবে।
সরকার-হেফাজত সম্পৃক্ততা ‘ইতিবাচক’: এক প্রশ্নের জবাবে ইইউ দূত পিয়েরে মায়েদুন সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পৃক্ততাকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখার ইঙ্গিত দেন। সামপ্রতিক উদ্যোগ বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বা ইনক্লুসিভ সোসাইটি গড়ার কাজে সহায়ক হবে আশা করে তিনি বলেন, সমাজের বিভিন্ন অংশ, যারা হয়তো আড়ালেই থাকতো, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পদক্ষেপ, আমি মনে করি এটি ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমপ্রতি গণভবনে হেফাজতে ইসলামীর নেতাদের উপস্থিতিতে ওলামাদের একটি অনুষ্ঠানে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে তিনি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ‘লেডি জাস্টিস’-এর ভাস্কর্য সরানোর কথাও বলেন। ভাস্কর্য অপসারণের দাবি ছিল হেফাজতসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের। অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া সংক্রান্ত সরকার প্রধানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সমালোচনায় মুখর রয়েছে বাম সংগঠনগুলো। ভাস্কর্যের সঙ্গে অন্য এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত মায়েদুন বলেন, এ নিয়ে দেশের নাগরিক সমাজই ভালো বলতে পারবেন। আমি মনে করি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ থাকা জরুরি। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নির্ভর করে কিছু দীর্ঘমেয়াদি বিষয়ের ওপর, যেগুলো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও উন্নয়নকে এগিয়ে নেবে। সমাজের কোনো অংশ বা কোনো পক্ষকেই মূলধারার বাইরে (দূরে) রাখা উচিত নয় মন্তব্য করে ইইউ দূত বলেন, যেকোনো এনগেজমেন্ট বা সম্পৃক্ততার কার্যকারিতা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখি।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে: ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে যাওয়া (ব্রেক্সিট) প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে নজর ছিল সবার। কারণ ফ্রান্সেও একই শোর তুলেছিলেন কট্টর ডানপন্থি নেতা লা পেন। অভিবাসন বিরোধিতার পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ফ্রান্সকে গুটিয়ে নেয়ারও ঘোষণা ছিল ন্যাশনাল ফ্রন্টের এই নেতার। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ফ্রান্সকে এগিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মধ্যপন্থি ইমানুয়েল ম্যাক্রোন। শেষ পর্যন্ত রোববার রান অফ ভোটে বিশাল ব্যবধানে লা পেনকে হারিয়ে ম্যাক্রোন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নও স্বস্তি পেয়েছে। এ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মায়েদুন বলেন, ইইউ অনেক নমনীয় একটি প্রতিষ্ঠান। ইইউ প্রতিষ্ঠার আগেও এ ধরনের বিতর্ক ছিল। আমরা এতে অভ্যস্ত, একে গ্রহণ করি এবং স্বাগত জানাই। ইইউ’র নীতি বাস্তবায়নের পথ পুনর্গঠনে এটি আমাদের সহায়তা করে। বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক বিষয়ে রাষ্ট্রদূত মায়েদুন বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের একটি ইতিবাচক অর্জন হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধার ফলে এখানে পোশাক শিল্প বেড়ে উঠেছে এবং কয়েক লাখ নারী দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এ সময় ইইউ-বাংলাদেশ বর্তমান সময়ের সম্পর্কের গভীরতা নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করে জ্যেষ্ঠ ওই কূটনীতিক। নিজের দেশ ফ্রান্সসহ অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, এখানে আমরা কখনও বন্ধ দরজার মুখোমুখি হইনি। যখনই আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি, ফিরিয়ে দেয়া হয়নি বরং কথা বলার জন্য কাউকে না কাউকে পেয়েছি, যিনি সবসময় আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=64748