৯ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩০

ঋণের চাপে বাড়ি ছাড়ছে হাওরপাড়ের মানুষ

‘মন চায় গলায় ফাঁস দিয়া মইরা যাই। ব্র্যাক সমিতিত্তে লুন নিছলাম, কৃষি ব্যাংকের লুন, আছে গ্রাম সুদে মহাজনের দেড়গুণ সুদে ট্যাহা। প্রতি মঙ্গলবার কিস্তি নিতে এনজিওর লোক আইয়া বইয়া থাহে। হে গোরে কইছি আমারে জেল নেইন, নাইলে বাড়ি বেইচ্যা নেইনগা।’ কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলেন, খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রামের মসজিদপাড়া এলাকার মো. আবুল মিয়া। আবুল মিয়ার তিন ছেলেমেয়ে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শনিবার সপরিবারে ঢাকা চলে গেছেন তিনি।

জানা গেছে, জেলার হাওরাঞ্চলে বন্যাকবলিত তিনটি উপজেলায়ই সরকারি নিষেধাঞ্জা মানছে না এনজিও কর্মীরা। ঋণের চাপে অনেক পরিবার এখন শহরে পাড়ি দিচ্ছে। ফলে উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলার একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, মহাজনের ঋণ ও এনজিওর কিস্তির চাপে ত্রাণের আশা ছেড়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতিদিন দু-চারটি পরিবার ভিটাবাড়ি ছেড়ে শহরের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বিদ্যালয়গুলোতে। বাড়িভিটা ছেড়ে যাচ্ছে এমন একাধিক পরিবারের সদস্যরা জানান, ঋণের যন্ত্রণায় আছি। বাড়ি তো ছাড়তেই হবে। তাই কাজ না করলে ঋণ দেবো কি দিয়ে? বর্ষায় সাধারণত হাওরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ফাঁকা থাকে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, মদন ও খালিয়াজুরী উপজেলার প্রায় ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনে ১ম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে বাবা- মায়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়েছে। শিক্ষকরা জানিয়েছেন, যাও উপস্থিত আছে এদের অধিকাংশ প্রথম সাময়িক পরীক্ষার জন্য রয়ে গেছে। কারো কারো বাবা-মা চলে গেছে। কেউ উপবৃত্তির টাকা বাতিলের ভয়ে। তবে পরীক্ষা শেষ হলে আরো কমবে। কেউ কেউ পরীক্ষা দিতে এসে কান্নাকাটি করেছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের কাছে রেখে যাওয়ায় কান্নাকাটি করছে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় এমন চিত্র ছিল মোহনগঞ্জ উপজেলার বরান্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন জানান, ১ম শ্রেণিতে ৬২ জনের মধ্যে উপস্থিত ৪৭ জন, ২য় শ্রেণিতে ৬৪ জনের মধ্যে ৪৬ জন, গাগলাজুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বঙ্কিম চন্দ্র পাল বলেন, শনিবার স্কুল খুলেছে। ১ম শ্রেণিতে ৬৯ জনের মধ্যে ৩৯ জন, ২য় শ্রেণিতে ৩৭ জনের মধ্যে ১৪ জন, ৩য় শ্রেণিতে ৩৯ জনের মধ্যে ২৯ জন, ৪র্থ শ্রেণিতে ৩২ জনের মধ্যে ১২ জন ও ৫ম শ্রেণিতে ৪১ জনের মধ্যে ১৫ জন অনুপস্থিত আছে। মল্লিকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ১ম শ্রেণিতে ২৩ জনের মধ্যে ৭ জন, ২য় শ্রেণিতে ২২ জনের মধ্যে ৫ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ১৬ জন, ৫ম শ্রেণিতে ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জন অনুপস্থিত।
খালিয়াজুরী উপজেলার পূর্ব জগন্নাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, গত শনিবার বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিকে ৩০ জনের মধ্যে ৭ জন, ১ম শ্রেণিতে ৯১ জনের মধ্যে ২৯ জন, ২য় শ্রেণিতে ৯৭ জনের মধ্যে ১৩ জন, ৩য় শ্রেণিতে ৫০ জনের মধ্যে ৯ জন, ৪র্থ শ্রেণিতে ৫০ জনের মধ্যে ৭ জন ও ৫ম শ্রেণিতে ৬ জন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত।
খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কল্যাণপুর ৫ নং কেন্দ্রের ফাতেমা ইসলাম বলেন, প্রতি মঙ্গলবার গ্রামীণ ব্যাংকের আইয়ুব খান ও ব্র্যাক ব্যাংকের সোহেল রানা কিস্তি নিতে আসে। হেগোরে কইছি সরকার নিষেধ করছে আপনারা আসেন কেন? তারা বলে, উপরের অর্ডার না আসলে আমরা কি করবো। এ ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংকের ফিল্ড কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলীকে মোবাইল ফোনে আপনাদের বিরুদ্ধে ঋণ আদায়ের আভিযোগ উঠছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমরা এলাকায় যাচ্ছি, যারা স্বেচ্ছায় কিস্তি দিচ্ছে তাদের নিচ্ছি। জোড়াজুড়ি করছি এ কথা কেউ বলতে পারবে না। এ ব্যাপারে ব্র্যাকের ফিল্ড কর্মকর্তা মো. সোহেল রানার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি।
মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মুরাদ, মাঘান শিয়াধার ইউপি চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক, খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. নাজিম উদ্দিন সরকার বলেন, আমার ইউনিয়নে প্রায় শতাধিক পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আবার দু’একজন ফিরেও আসছে। তারা বলছে, মহাজন ও এনজিও ঋণের জন্য চাপ দিচ্ছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিনকে হাওরাঞ্চলের তিনটি উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি আশংকাজনক হারে বেড়েছে এ ব্যাপারে আপনার মনিটরিং আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আগে শুনিনি। এমনটা হতেই পারে।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ তোফায়েল আহমেদ ও মোহনগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমরা এনজিওদের মিটিং করে জানিয়ে দিয়েছি। তারপরও যদি কেউ কিস্তির টাকার জন্য চাপ দেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=64690&cat=6/