৯ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৬

হাসপাতালে বসেই রাজনীতি করছেন সাংসদ আমানুর!

আমানুর রহমান খান রানাখুনের মামলার আসামি সাংসদ আমানুর রহমান খান রানা কারাগারে না থেকে তিন মাস ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনে আছেন। সেখানে বসেই দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে নিয়মিত সভা ও রাজনৈতিক শলা-পরামর্শ করছেন টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সরকারদলীয় এই সাংসদ। কারা কর্তৃপক্ষের নথিতে তাঁর গুরুতর কোনো রোগের উল্লেখ নেই। শুধু লেখা ‘ইউরোলজিক্যাল’ (মূত্রাশয়জনিত) সমস্যা।

কারারক্ষী ও পুলিশ পাহারায় বন্দী এই জনপ্রতিনিধি হাসপাতালে বসে সভা করতে পারেন কি না, জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর কবির গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, আসামির কেবিনে কাউকে ঢুকতে হলে কর্তব্যরত কারারক্ষী ও পুলিশের অনুমতি নিতে হয়। এ বিষয়ে তদারকির জন্য একজন উপকারাধ্যক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। হাসপাতালে বসে সভা করার কথা নয়। তিনি খোঁজ নেবেন বলে জানান। পরে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, উপকারাধ্যক্ষকে ওই কেবিনে পাঠানো হয়েছে।

সাংসদ আমানুর রহমান টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২২ মাস তিনি পলাতক ছিলেন। এরপর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তখন থেকে তিনি কারাবন্দী। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন থানায় পাঁচটি হত্যাসহ ৪৭টি মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গত বছরের নভেম্বরে কারাগারে বসে ছাত্রলীগের স্থানীয় এক নেতাকে তিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে আমানুর টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪৯ নম্বর ভিআইপি কেবিনে ভর্তি করা হয়। টাঙ্গাইল কারা কর্তৃপক্ষ সাংসদ আমানুরের ‘ইউরোলজিক্যাল’ সমস্যা রয়েছে বলে নথিতে উল্লেখ করেছে।

হাসপাতালের কর্তব্যরত একাধিক নার্স প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ আমানুর তাঁর চিকিৎসার ফাইলপত্র বিছানা থেকে বাইরে নিতে দেন না। চিকিৎসক বিছানায় গিয়ে ফাইল দেখে ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কেবিনের সামনে দেখা যায়, তিনজন পুলিশ সদস্য ও একজন কারারক্ষী বসে আছেন। ওই সময় কেবিন থেকে ২০-২৫ জনকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। সাংসদ কেবিনের খাটে বসে ছিলেন।
খাটের পাশে টেবিলের ওপর একটি টেলিভিশন রয়েছে। কেবিন থেকে বেরিয়ে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা ঘাটাইল এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী পরিচয় দিয়ে বলেন, সাংসদকে তাঁরা দেখতে এসেছেন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
সাংসদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ না পাওয়া ইকবাল হোসেন নামের এক যুবক বলেন, তিনি ঘাটাইল আওয়ামী লীগের কর্মী। মাঝেমধ্যে সাংসদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সাংসদ ডায়াবেটিসে ভুগছেন বলে তাঁরা শুনেছেন।
কর্তব্যরত পুলিশের হাবিলদারের কাছে জানতে চাওয়া হয় সাংসদ আমানুরের কেবিনে কারা থাকেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘ওনার (সাংসদ) কেবিনে সার্বক্ষণিক একজন অর্ডারলি (ব্যক্তিগত সহকারী) থাকে। সে বাইরে থেকে খাবার-দাবার আইনে দ্যায়, মানুষজন দ্যাখা করতে এলে তাঁর অনুমতি নেয়, তাঁর অনুমতি পাওয়ার পর ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যায়।’ তিনি বলেন, আজ এখন পর্যন্ত (বেলা সাড়ে ১১টা) সাংসদের সঙ্গে এক শ থেকে দেড় শ নেতা-কর্মী দেখা করেছেন। কেবিনের করিডরে আট-নয়জন যুবককে দেখিয়ে তিনি বলেন, তাঁরাও দেখা করতে এসেছেন। এরই মধ্যে ওই যুবকেরা দরজায় টোকা দিলে হলুদ টি-শার্ট ও লুঙ্গি পরা এক ব্যক্তি দরজা খুলে ওই যুবকদের বলেন, স্যারের সঙ্গে দেখা করতে হলে পরে আসতে হবে। এ কথা শুনে যুবকেরা চলে যান। ওই ব্যক্তি তাঁর নাম মো. মিন্টু বলে জানান।
আগের দিন রোববার বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় সাংসদের কেবিনের সামনে দেখা যায়, তিনজন কারারক্ষী ও পুলিশের তিনজন সদস্য চেয়ারে বসে আছেন। এ সময় সাংসদের সঙ্গে দেখা করতে আসা এক যুবক দরজা খুলে কেবিনের ভেতরে ঢোকেন। তখন দেখা যায়, আমানুর রহমান সাদা ফতুয়া ও চেক লুঙ্গি পরে খাটে বসে টেলিভিশন দেখছেন। তাঁকে ঘিরে থাকা ছয়-সাতজনের সঙ্গে তিনি গল্প করছেন। কারারক্ষী ও কর্তব্যরত পুলিশের কাছে ভেতরে কারা আছে জানতে চাওয়া হলে তাঁরা বলেন, তাঁরা সাংসদের এলাকার দলীয় নেতা-কর্মী। সব সময়ই এলাকার লোকজন আসেন। রাতে স্বজনেরা এসে তাঁর সঙ্গে থাকেন।
কেবিন ব্লকে কর্তব্যরত একাধিক কর্মচারী বলেন, সাংসদের কক্ষে সারা দিনই দলীয় লোকজনের সভা হয়। হাসপাতাল থেকে দেওয়া খাবার তিনি খান না। বাইরে থেকে খাবার আসে।
সাংসদের কী রোগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইউরোলজি বিভাগের প্রধান মো. আমানুর রসুলের অধীনে চিকিৎসাধীন আছেন এই সাংসদ। অধ্যাপক আমানুর রসুল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১০-১২ দিন আগে সাংসদ আমানুরকে পেয়েছেন। তাঁর মূত্রনালিতে সমস্যা ছিল। ওষুধ দেওয়ার পর এই সমস্যা এখন আর নেই। তাঁর পায়ুপথে সমস্যা আছে। এ কারণে তাঁকে দু-তিন দিন আগে জেনারেল সার্জারি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে ওই বিভাগের অধ্যাপক ঢাকার বাইরে থাকায় তিনি তাঁকে দেখতে পারেননি।
এর আগে সাংসদ কার তত্ত্বাবধানে ছিলেন জানতে চাইলে অধ্যাপক আমানুর বলেন, ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. শফিকুল আলম চৌধুরীর অধীনে ছিলেন। জানতে চাইলে অধ্যাপক শফিকুল বলেন, সাংসদ প্রথমে তাঁর অধীনে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে পায়ুপথে সমস্যা আছে জানানো হলে তিনি জেনারেল সার্জারি বিভাগে স্থানান্তর করে দেন। এরপর সাংসদ নিজেই ইউরোলজি বিভাগের প্রধানের অধীনে থাকতে চান।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা
সাংসদ আমানুর টাঙ্গাইলের আদালতে হাজির না হওয়ায় ফারুক হত্যা মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি হচ্ছে না। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ছয়বার শুনানি পিছিয়ে যায়। মামলাটি এখনো অভিযোগ গঠনের অপেক্ষায় আছে।
এদিকে ফারুক হত্যা মামলায় সাংসদ আমানুর রহমান গত ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন। পরে চেম্বার বিচারপতি তা স্থগিত করেন। গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্ট এই স্থগিত আদেশের মেয়াদ চার মাসের জন্য বৃদ্ধি করেন। একই সঙ্গে ছয় মাসের মধ্যে এর বিচার শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন চার মাসের জন্য মুলতবি রেখে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
সাংসদ যেভাবে আসামি হলেন
২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাতে টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমদের গুলিবিদ্ধ লাশ টাঙ্গাইলে তাঁর কলেজপাড়ার বাসার সামনে পাওয়া যায়। ঘটনার তিন দিন পর তাঁর স্ত্রী নাহার আহমেদ টাঙ্গাইল মডেল থানায় মামলা করেন। ২০১৪ সালের আগস্টে এ মামলায় আনিছুল ইসলাম ওরফে রাজা ও মোহাম্মদ আলী নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, সাংসদ আমানুর রহমান খান ও তাঁর তিন ভাই ফারুক হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এরপর থেকে আমানুর ও তাঁর ভাইয়েরা আত্মগোপনে ছিলেন।
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ডিবি পুলিশ সাংসদ আমানুর রহমান ও তাঁর তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র ও টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুর রহমান খান মুক্তি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকনসহ ১৪ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এরপর ৬ এপ্রিল আদালত মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক আমানুরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে ওই বছরের ১৬ জুন আদালত আসামিদের হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন। আমানুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি চিঠি দিয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে জানানো হয়। ২২ মাস পলাতক থাকার পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আমানুর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
হত্যা পরিকল্পনায় সাংসদের নাম
গত বছরের ৯ নভেম্বর রাতে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের ব্রাহ্মশাসন গণবিশ্ববিদ্যালয় (জিবিজি) কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি আবুল সাঈদ ওরফে রুবেলেক গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন ১৭ জনকে আসামি করে ঘাটাইল থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করা হয়। তারা সবাই সাংসদ আমানুরের সহযোগী। মামলাটি টাঙ্গাইলের ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে। আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় সাংসদের সহযোগী টাঙ্গাইল ছাত্রলীগের নেতা আতিকুর রহমান, যুবলীগের নেতা আজিজুল হক ওরফে রুনু ও জব্বার বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে জব্বার বাবু গত বছরের ২০ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের বিচারিক হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, কারাগারে বসে সাংসদ আমানুর ছাত্রলীগের নেতা আবু সাঈদকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সাংসদের নির্দেশেই সাঈদকে হত্যার জন্য হামলা চালানো হয়। জব্বার বাবু আদালতকে বলেন, সাংসদের সঙ্গে কারাগারে দেখা করে ও তাঁর ঘাটাইলের বাসায় বসে সাঈদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করা হয়।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের নেতা সাঈদ হত্যাচেষ্টার মামলায় নতুন কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1174031/