১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:২৩

প্রতিবেশীদের তুলনায় দেশে হার্টের রিংয়ের দাম কেন এত বেশি?

 

দেশে হার্টের রিংয়ের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটটি নিজেরা রিংয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। কিছু রিংয়ের দাম পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করছে তারা। দেশের ২৭টি কোম্পানি হার্টের রিং আমদানি করে। ওই সিন্ডিকেটের আমদানি করা রিংয়ের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে।

রিং সিনার্জি-প্রস্তুতকারক বোস্টন সায়েন্টিফিক লিমিটেড। এটি ভারতে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি টাকায় ৫৩ হাজার। অথচ বাংলাদেশে এই রিংয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। প্রোমুস এলিট-এটা ভারতে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশে নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা। প্রোমুস প্রিমিয়ার ভারতে বিক্রি হচ্ছে ১২ হাজার টাকা।

অথচ বাংলাদেশে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৩ হাজার টাকা। রিসোলুট অনিক্স- প্রস্তুত কারক মেডট্রোনিক। এটা ভারতে বিক্রি হচ্ছে ৫৩ হাজার টাকায়। অথচ বাংলাদেশে দাম নির্ধারণ হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। 

জিয়েন্স এক্সপেন্ডিশন-প্রস্তুতকারক এভোথ ভ্যাসকুলার। এটি ভারতে বিক্রি হচ্ছে ৫৩ হাজার টাকা। অথচ বাংলাদেশে এই রিংয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা।

জিয়েন্স অ্যালপাইন-এটা ভারতে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি টাকায় ৫৩ হাজার। একই রিং বাংলাদেশে দাম নির্ধারণ হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা।

গত ১২ই ডিসেম্বর সরকার নির্ধারণ করা রিংয়ের খুচরা দামের তালিকার সিরিয়ালে ৭, ১৯ ও ২০ নম্বর ছাড়া বাকি কোম্পানির রিংয়ের সর্বোচ্চ দাম প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। আর ৭, ১৯ ও ২০ নম্বর সিরিয়ালের রিংয়ের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। 

২৪টি কোম্পানির রিংয়ের যে দাম ঠিক করেছে তা দিয়ে তারা কিনতেও পারবে না- অভিযোগ পাওয়া গেছে। শেষ পর্যন্ত তিনটি কোম্পানি টিকে থাকবে। আর তিনটির সঙ্গে জড়িত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন। তার স্ত্রী খুরশীদ জাহান এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান। বাকি ২টির সঙ্গেও মীর জামাল উদ্দিন জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এখানে ৩টি কোম্পানি দাম কমায়নি। যার ফলে অন্যরা আর আমদানিই করতে পারবেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।

সমপ্রতি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটকে সাড়ে ৭ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে এই অর্থে গরিব রোগীদের চিকিৎসায় হার্টের রিং ও পেসমেকার কেনা শুরু হবে। পরিচালকের স্ত্রীর কোম্পানি এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ম্যাট্রোনিক থেকে ওই রিং ও পেসমেকার কেনা হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহাবুবুর রহমান ডালিম, তার স্ত্রী মাসুমা আক্তার ও হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ওয়ার্ড মাস্টার হাসানুজ্জামান টিপুর স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তার কোম্পানিটির পরিচালক। 

মাহাবুবুর রহমান ডালিম এ বছরের শুরুর দিকে এইচআরএস ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির নামে বাংলাদেশে হার্টের রিং ও পেসমেকার সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ম্যাট্রোনিক বাংলাদেশ লিমিটেডের ডিলারশিপ নেন। এতে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা লাগে। এ ঘটনায় আর্থিক সংকটে পড়লে এইচআরএস ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির অধীনে তিনি এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি সাব- কোম্পানি খোলেন। এখানেই চেয়ারম্যান করা হয়েছে এনআইসিভিডি পরিচালকের স্ত্রী খুরশীদ জাহানকে।

তবে এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহাবুবুর রহমান ডালিম মানবজমিনকে বলেন, শুরুতে তার কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন এনআইসিভিডি পরিচালকের স্ত্রী খুরশীদ জাহান। বর্তমানে খুরশীদ জাহান এই ব্যবসায় নেই বলে দাবি করেন ডালিম। তিনি আরও জানান, তিনি ও তার স্ত্রী এই রিংয়ের ব্যবসা করছেন। ডালিম বলেন, তাদের কোম্পানির রিংয়ের দাম ২ থেকে ৩ মাস আগে কমানো হয়েছে। যেখানে ১ লাখ ৮ হাজার থেকে বর্তমানে ৭৮ হাজার ৪০০ টাকা বিক্রি করছেন বলে জানান তিনি।  

ডালিম গত মে মাসে এইচআরএস ইন্টারন্যাশনালের অধীনে নতুন কোম্পানিটি খোলেন। ডিলারশিপ নিতে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এই বিনিয়োগের একটি বড় অংশ আসে ইনস্টিটিউটের পরিচালকের স্ত্রীর কাছ থেকে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে মাসে ২০০ থেকে ২৫০টি হার্টের রিং এবং ৩০০ পেসমেকার পরানো হয়, যার প্রায় অর্ধেক নেয়া হয় ম্যাট্রোনিক বাংলাদেশ লিমিডেট থেকে। প্রতিটি রিংয়ের দাম পড়ে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা। দেশের অনেক বড় বড় হাসপাতালও এই কোম্পানি থেকে হার্টের রিং ও পেসমেকার নেয়। এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান খুরশীদ জাহান মূলত গৃহিণী। ডালিম এক সময় হার্টের রিং ও পেসমেকার সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতেন। তার স্ত্রী মাসুমা আক্তার ও ওয়ার্ড মাস্টার হাসানুজ্জামান টিপুর স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তারও গৃহিণী। 

এদিকে, ১২ই ডিসেম্বর দেশে ব্যবহৃত ২৭টি কোম্পানির ৪৪ ব্র্যান্ডের হার্টের রিংয়ের দাম কমিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ১৬ই ডিসেম্বর থেকে এ দাম কার্যকর হবে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঔষধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩ এর ধারা ৩০ (১) অনুসারে হার্টের রিংয়ের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য পুনঃনির্ধারণ করা হলো। কার্ডিয়াক চিকিৎসা দেয়া সব হাসপাতালকে এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে অনুরোধ করা হলো।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সব হাসপাতালে নোটিশ বোর্ডে হার্টের রিংয়ের তালিকা প্রদর্শন করতে হবে। 
রিংয়ের খুচরা দাম সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার টাকা। বহুল ব্যবহৃত যে সব রিংয়ের দাম কমেছে সেগুলো হলো- পোল্যান্ডের অ্যালেক্স প্লাসের দাম ৬২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে কমে ৫৩ হাজার টাকায় নেমেছে। আয়ারল্যান্ডের জিয়েন্স প্রাইম ৭২,৫০০ টাকা থেকে কমে ৬৬,৬০০ টাকা হয়েছে। একই কোম্পানির জিয়েন্স এক্সপেন্ডিশন ১ লাখ ৮ হাজার ৬২৮ টাকা থেকে কমে হয়েছে ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং জিয়েন্স অ্যালপাইন ১ লাখ ৪৯ হাজার থেকে কমে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। জার্মানির জিলমুসের দাম ৬০ হাজার থেকে কমে হয়েছে ৫৩ হাজার টাকা। আয়ারল্যান্ডের মেডট্রোনিকের রেজোলুটে ওনিক্সের দাম ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা থেকে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আমেরিকার বোস্টন সায়েন্টিফিকের প্রোমুস প্রিমিয়ারের দাম ৭৫ হাজার থেকে কমে হয়েছে ৭৩ হাজার টাকা, প্রোমুস এলিটের দাম ১ লাখ ১২ হাজার থেকে কমে হয়েছে ৯৩ হাজার টাকা এবং একই কোম্পানির সিনার্জি ব্র্যান্ডের রিংয়ের দাম ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা থেকে কমে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা।

সুইজারল্যান্ডের বায়োম্যাট্রিক্স নেওফ্লিক্সের দাম ৬২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে কমে হয়েছে ৫৮ হাজার টাকা। একই কোম্পানির বায়োম্যাট্রিক্স আলফা ৮৬ হাজার টাকা থেকে কমে হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। নেদারল্যান্ডসের অ্যালবুমিনাস ডিইএস প্লাসের দাম ৭২ হাজার টাকা থেকে কমে হয়েছে ৫৪ হাজার টাকা। সুইজারল্যান্ডের বায়োফ্রিডম ৬৫ হাজার, প্রি-কিনেটিক ১৫ হাজার টাকা, আইট্রিক্স ৩৬ হাজার টাকা, ওসিরা মিশন ৬৫ হাজার টাকা, আয়ারল্যান্ডের ডিইএসওয়াইএনসি ৫৫ হাজার, সুপরাফ্ল্যাক্স ৫৩ হাজার, জাপানের আল্টিম্যাস্টার ৬০ হাজার, স্পেনের এনজিওলাইট ৫৩ হাজার, আইভাসকুলার এনজিওলাইট ৫৩ হাজার টাকা, আইএইটি ডেস্টিনি ৫৩ হাজার টাকা, নেদারল্যান্ডের কমবো প্লাস ৫৩ হাজার টাকা, ভারতের বায়োমিমে ৪০ হাজার টাকা, এভারমাইন-৫০  ৪০ হাজার টাকা, মেটাফোর ৩৫ হাজার টাকা, জার্মানির সিসি ফ্লাক্সে ১৫ হাজার টাকা, ইকা লিমুস ৫৩ হাজার টাকা, ইউকোন চয়েজ পিসি ৫৩ হাজার টাকা, অর্থস পিকো ১৫ হাজার টাকা, আবিরস ৫৩ হাজার টাকা, করোফ্লিক্স আইএসআইআর ৫৩ হাজার টাকা, ম্যাগমা ৩৭ হাজার টাকা।

সুনা স্ট্যান্ট ১৪ হাজার টাকা, যুক্তরাষ্ট্রের কোবাল্ট ক্রোমিয়াম ৫৫ হাজার টাকা, ডিরেক্ট স্ট্যান্ট সিরো ৫৫ হাজার টাকা, ডিরেক্ট স্ট্যান্ট ২০ হাজার টাকা, দক্ষিণ কোরিয়ার জিনোস ডিইএস ৪৫ হাজার টাকা, ইতালির অ্যাভেন্টগার্ড ১৫ হাজার টাকা, সিআরই-৮  ৫৩ হাজার টাকা, পোল্যান্ডের অ্যালেক্স ৫৩ হাজার টাকা, ফ্রান্সের অ্যামাজোনিয়া ৫৩ হাজার টাকা নির্ধারিত হয়েছে।

এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও  উপ-পরিচালক (আইন কর্মকর্তা) মো. নুরুল আলম মানবজমিনকে বলেন,  কেউ যদি বেশি দামে হার্টের রিং বিক্রি করে তাহলে দু’বছরের জেল অথবা দু’লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় কোনো প্রতিষ্ঠান সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে হার্টের রিং বিক্রি করছে তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

https://mzamin.com/news.php?news=88414