৯ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৩

ওয়ান স্টপ সার্ভিস : খসড়া অনুমোদন

আইনের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান উদ্যোক্তারা

বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনের’ সঠিক কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তারা মনে করছেন, দেশে অনেক আইন, বিধি ও নীতিমালা রয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা হল- সর্বত্র এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। তাই দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে মুক্ত রাখতে না পারলে এ আইনেরও কার্যকারিতা থাকবে না। ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনকে কার্যকর করতে হলে ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় প্রস্তাবিত সুবিধাদি যথাসময়ে সরবরাহ দেয়ার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। উদ্যোক্তারা জানান, ওয়ান স্টপ সার্ভিসকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা না গেলে এ আইন শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। নতুবা এ আইনের সুফল উদ্যোক্তা পর্যায়ে পৌঁছবে না।

সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বহু প্রতীক্ষিত ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন-২০১৭’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন পাওয়ার পর যুগান্তরের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় দেশের শীর্ষ উদ্যোক্তা এবং অর্থনীতিবিদরা তাদের সন্দেহের কথা জানান।

অনুমোদিত আইন সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানায়, এ আইন হলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ‘কেন্দ্রীয় ওয়ান স্টপ সার্ভিস কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। এখানে মোটামুটি ১৬ ধরনের সেবা পাবেন উদ্যোক্তারা। ট্রেড লাইসেন্স, জমি রেজিস্ট্রেশন, নামজারি, পরিবেশ ছাড়পত্র, নির্মাণ অনুমোদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ, টেলিফোন-ইন্টারনেট সংযোগ, বিস্ফোরক লাইসেন্স, বয়লার সার্টিফিকেটসহ ২৭টি ক্যাটাগরিতে এসব সেবা দেয়া হবে। এক জায়গায় বসেই যাতে এসব অনুমোদন পাওয়া যায়, সে সুযোগ রাখা হচ্ছে এ আইনে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি একে আজাদ বলেন, ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিসকে একটি আইনি কাঠামোয় আনার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে মোটেও আশাবাদী হতে পারছি না। কারণ বাংলাদেশে অনেক আইন আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে এর প্রয়োগ হয় খুব কম। আবার যারা এটি বাস্তবায়ন করবেন, সেই দায়িত্বশীলদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধের ঊর্ধ্বে থাকে না।’ তিনি বলেন, ‘এ আইনে যেসব সুবিধার কথা বলা হচ্ছে, তা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু কার্যকর হতো না। এখন নতুন আইনের ফলে উদ্যোক্তার সেবাপ্রাপ্তির অধিকার তৈরি হল মাত্র। তবে সেবা সরবরাহে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের সীমাবদ্ধতাও অনেক। তাদেরও অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। এতে করে সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আবেদনের ডেলিভারি জট তৈরি হবে। তখন দেখা যাবে, চাপ সামলাতে গিয়ে তারা সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদেরই সেবা সরবরাহে প্রাধান্য দিচ্ছেন। আর উপেক্ষিত হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরের বিনিয়োগকারীরা। আমরা তাই আশঙ্কামুক্ত হতে পারছি না।’

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘বিনিয়োগ বোর্ডের অতীতের অভিজ্ঞতা ভালো না। নতুন এ আইনে কার্যকর ফল পেতে একজন ভালো ব্যবসায়ীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সেখানে বসাতে হবে। কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেক কিছু এদেশে করা সম্ভব হয় না।’

তবে মন্ত্রিপরিষদে আইনটি অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বলেন, ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস বা বিনিয়োগ বোর্ড আগেও ছিল। কিন্তু সেটি বেশি কার্যকর হয়নি। কারণ আইনি কাঠামো ছিল না। এখন আইনের ফ্রেমওয়ার্কে চলে আসবে। কেউ যদি ফেল করে বা কমপ্লাই না করে, তাহলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাবে।’

বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাস্তবায়ন পর্যায়ে সন্দিহান হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তাই সংশয়ও আছে। তবে আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে সেবা পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হল। যদি সেটা সত্যিকার অর্থেই কার্যকরী হয়। তাই আইনটি কার্যকরের জন্য সরকারকেই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এর জন্য দায়িত্বশীলদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এখানে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তাদের দেশপ্রেমিক হতে হবে। নতুবা আইন হলেও তার সুফল মিলবে না।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস সুবিধাকে একটা আইনি রূপ দেয়ার দাবি উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের। এখন সেটা হতে যাচ্ছে। আমরা এতে খুশি। কিন্তু এটাও বলতে চাই, আইন পাস করেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এর কার্যকারিতা নিয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে। নতুবা এর সুফল পাওয়া যাবে না। ওয়ান স্টপ সার্ভিস ঠিকমতো কাজ না করলে এর নেতিবাচক প্রচারণা দেশে-বিদেশে চাউর হবে। তখন বিনিয়োগ ও ভাবমূর্তি সংকট আরও তলানিতে নামবে।

এ প্রসঙ্গে অবশ্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম জানান, এ আইনের অধীনে উদ্যোক্তাদের পর্যাপ্ত গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সংযোগ নিশ্চিত করা হবে।

জানা গেছে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার জন্য এবং তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতেই এ আইন করা হচ্ছে। ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ‘ডুয়িং বিজনেস ২০১৭’ প্রতিবেদনে ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে এ সূচকে একশ’র নিচে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। সেটা করতে গেলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য একটা শর্ত ছিল ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন’ প্রবর্তন করার।

আইনের বিষয়বস্তু তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বলেন, এটা ছোট্ট একটা প্যাকেজ আইন। এটাতে মূলত ওয়ান স্টপ সার্ভিস কীভাবে পরিচালিত হবে, তার একটা আইডিয়া দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের কোন সেবা কত দিনের মধ্যে দিতে হবে, তা বিধি দিয়ে নির্ধারণ করা হবে আইনে। কেউ বিধি না মানলে আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইনের খসড়া অনুযায়ী, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি নাম ছাড়পত্র প্রদান করবে। নিবাসী-অনিবাসী ভিসা দেবে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে ঘোষণা দেবে বেজা বা হাইটেক পার্ক। অর্থনৈতিক রফতানি প্রক্রিয়া এলাকা দেবে বেপজা। ওয়ার্ক পারমিট দেবে বেজা, বেপজা বা হাইটেক পার্ক। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন- সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা দেবে ট্রেড লাইসেন্স। ভূমি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন থেকে ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন। এছাড়া জমি কেনাবেচা ও ইজারার রেজিস্ট্রেশন করবে রেজিস্ট্রেশন বিভাগ, নামজারি হবে ভূমি অফিসে। পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়া যাবে পরিবেশ অধিদফতরে। বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন বসানোর অনুমোদন এবং সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দেবে। এছাড়া ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা (যেখানে যেটি প্রযোজ্য) দেবে পানি সংযোগ। টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ মিলবে বিটিসিএলের কাছ থেকে। অগ্নিনিরোধ সংক্রান্ত সেবা পাওয়া যাবে ফায়ার সার্ভিস থেকে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/09/123318/