১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৫:০৭

জলাশয় ভরাট করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান

রাজধানীতে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জলাশয় ও জলাভূমি ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ তুলেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশকর্মী ও বিশিষ্টজনরা। তাঁরা বলেছেন, এসব ঘটনা স্থাপনা নির্মাণ আইন ও সংবিধান লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত। আইনের শাসন ও জনগণের কাছে জবাবদিহির ঘাটতি বসবাসের ক্ষেত্রে ঢাকাকে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে।

গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এসব কথা বলেন।

রাজধানীর বাংলামোটরের প্ল্যানার্স ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা/ড্যাপ (২০২২-২৩) বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা : বিএডিসি ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জলাশয় ভরাট প্রসঙ্গে’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বিআইপির নির্বাহী বোর্ডের সদস্য পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জলাশয় ভরাট জলাধার সংরক্ষণ আইনের (২০০০) ৫ ধারার লঙ্ঘন। এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে (২০১০ সালে সংশোধিত) জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাতিরঝিলসহ ঢাকায় অবস্থিত প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহে অবরোধ তৈরি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-২৫ আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

মূল প্রবন্ধে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিআইপি পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার জলাধার ও জলাভূমি অঞ্চলগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে রাজধানীতে জলাধার ও জলাভূমি অঞ্চল ছিল ৩০.২৪ বর্গকিলোমিটার, যা মোট এলাকার ২০.৫৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে আয়তন দাঁড়িয়েছে ৪.২৮ বর্গকিলোমিটারে, যা মোট এলাকার ২.৯১ শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের নির্মাণের আওতায় এসেছে নগরীর ৭৬.৭৮ শতাংশ এলাকা।

অথচ আদর্শ শহরে ১০ থেকে ১২ শতাংশ জলাভূমি থাকার নিয়ম রয়েছে।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের নগর জনসংখ্যার হার বর্তমানে ৫৫ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। এই প্রবৃদ্ধি প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে পরিবেশ তার নিজস্ব সক্ষমতায় টেকসই রূপে থাকতে অসমর্থ হচ্ছে।

সূচনা বক্তব্যে বিআইপি সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকার কেন্দ্রীয় নগর এলাকায় ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জলাধার ও সবুজ এলাকা যথাক্রমে প্রায় ৩০.৯৮ শতাংশ এবং ২৬.০৭ শতাংশ থেকে ৪.৬০ শতাংশ ও ২২.৮৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় এলাকার নির্মিত অংশ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তা ২৬.৪৫ শতাংশ থেকে ৪৯.৫৩ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিআইপির পক্ষ থেকে ফজলে রেজা সুমন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) জলাভূমি ভরাট, পুকুর ভরাট করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভবন নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে হতিরঝিল ভরাট ও বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের আশকোনা জলাধার ভরাট। 

তিনি জানান, এ বিষয়ে বিআইপি রাজউক, মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের জলাভূমি ভরাটের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন উপস্থিত আলোচকরা।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘আইনের শাসন এতই দুর্বল যে বিএডিসির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সুশাসন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জবাবদিহির অভাব এমন ঘটনার পেছনে দায়ী। রাজনৈতিক ও আইনের শাসনের দুর্বলতায় আমার একটি আইন না মানার সংস্কৃতিতে বসবাস করছি।’

জলাশয় ভরাটের ঘটনাকে সংবিধান লঙ্ঘন উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফেতখারুজ্জামান বলেন, ‘সংবিধান লঙ্ঘন করে, সংশ্লিষ্ট আইন লঙ্ঘন করে বিএডিসি জলাভূমি ধ্বংসকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। জলাভূমি ভরাট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন লঙ্ঘনের এ দৃষ্টান্ত নিন্দনীয়।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক ও ইফাদ (ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট) এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। তাদের নীতিমালায় পরিবেশ বিনষ্ট করে নির্মাণের নিষেধ রয়েছে। তাই এ দেশের নাগরিক হিসেবে সংস্থা দুটিকে জবাবদিহির সম্মুখীন করার অধিকার আমাদের রয়েছে। ড্যাপ লঙ্ঘন করে যারা জলাভূমি এবং সবুজ এলাকা ধ্বংস করছে, তাদের আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব রাজউকসহ সবার।’

নগর গবেষণা কেন্দ্রের (সিইউএস) সহসভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক গোলাম মোর্তুজা বলেন, ‘ভূমির অপব্যবহারে বরং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই এগিয়ে। এসব অনিয়মের কারণ হিসেবে আমি মনে করি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নির্ধারিত কোনো হার্ডলাইন নেই। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমাদের দেশের জন্য একটি ন্যাশনাল আরবান পলিসি নেই, যা দুঃখজনক।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, ‘বিএডিসির ভরাটকৃত জায়গাটির পাশেই বয়ে গেছে গদ্দারটেক খাল। বিএডিসি কেবল সেখানে গবেষণাকেন্দ্র করছে না, বীজভাণ্ডার, কোল্ড স্টোরেজ থেকে শুরু করে অনেক বড় পরিকল্পনা করেছে, যা জলাধারগুলোকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/12/14/1345448