১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৫:০৭

নির্বাচনবিরোধী সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে আইনজ্ঞরা

ইসির সিদ্ধান্ত সংবিধান লঙ্ঘন

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে ভোট গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনবিরোধী যেকোনো ধরনের সভা-সমাবেশের অনুমতি না দিতে পুলিশকে নির্বাচন কমিশনের দেয়া চিঠিকে সংবিধান পরিপন্থি, নাগরিকের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ এবং বেআইনি বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে কেউ কেউ উল্টো প্রশ্ন করেছেন, নির্বাচন কমিশন দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছে কি না? পুলিশ যদি ইসির কথামতো এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে তাহলে পুলিশও সংবিধান লঙ্ঘন করবে। সংবিধান ও আইন পরিপন্থি কোনো আদেশ মানতে পুলিশ বাধ্য নয়। গতকাল বুধবার ইনকিলাবের সঙ্গে আলাপকালে এ মন্তব্য করেন তারা।
এর আগে বুধবার এ বিষয়ে মহা-পুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি)-কে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই দফতরের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-৬ থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব হাবিবুল হাসানের স্বাক্ষরে চিঠিটি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আগামী বছর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচার- প্রচারণা শুরু হবে। ১৮ ডিসেম্বর থেকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ছাড়া নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে বা ভোটাররা ভোটপ্রদানে নিরুৎসাহিত হতে পারে এমন কোনো প্রকার সভা- সমাবেশ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন থেকে সবাইকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।

 

চিঠিতে আরো বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ছাড়া অন্য কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা থেকে সবাইকে বিরত রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে পুলিশকে দেয়া সরকারের এই চিঠির মর্মার্থকে সম্পূর্ণ অসংবিধানিক বলে মন্তব্য করেন আইনজ্ঞরা।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, ইসির বরাত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া এ চিঠির মর্মার্থ সুস্পষ্ট সংবিধান লঙ্ঘন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পরিপন্থি। এটি কখনো হয়নি। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসির সকল সদস্য শপথ ভঙ্গ করেছেন। এটি তাদের এখতিয়ারে পড়ে না। তাদের পদত্যাগ করা উচিত। একটি উপ-নির্বাচন করার ক্ষমতাই যাদের নেই, তারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও করতে পারবে না। এটি সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজে থেকে করেননি, সরকারি নির্দেশে করেছেন। মনে হচ্ছে ইসি কারফিউ জারি করেছে।

‘হিউম্যান রাইস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ (এইচআরপিবি)-এর প্রেসিডেন্ট সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, মিছিল-সভা-সমাবেশ করা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সংবিধান নাগরিককে এ অধিকার দিয়েছে। সেখানে কিভাবে নির্বাচন কমিশন এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়? নির্বাচনের কথা বলে ইসি তো মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপগুলো যে সার্বজনীন এবং সঠিক হবে নাÑ এটি তো তাদের ইতিপূর্বেকার কার্যকলাপ ও পদক্ষেপ দেখেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচনে যারা অংশ নেবে কিংবা যারা অংশ নেবে নাÑ তাদের সবার জন্যই সমান সুযোগ সৃষ্টি করবে না এটি তো জানাই আছে। নির্বাচনে যারা যাবেন না তারা নির্বাচনের বিপক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালাবেন এটি তো নির্বাচন বর্জনকারীরা আগে থেকেই বলে আসছেন। তাদের এ সিদ্ধান্ত তো নির্বাচন কমিশনের বিপক্ষে। তাই যে বিষয়গুলো নির্বাচন কমিশনের বিপক্ষে যাবে সেগুলো বন্ধ করার জন্যই তো ইসি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত মানুষ কতটা মানবে সেটি হচ্ছে প্রশ্ন।

সিনিয়র এ আইনজ্ঞ বলেন, মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ ইসির নেই। নির্বাচনের পক্ষে হলে সভা-সমাবেশ করতে পারবে, নির্বাচনের বিপক্ষে হলে সভা করা যাবে নাÑ এমনটি তো সংবিধান কিংবা নির্বাচন কমিশনের আইনেও নেই। এ কারণে তাদের সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবেÑ সময়ই তা বলে দেবে।

অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মঈদুল ইসলাম অভিন্ন প্রশ্নে বলেন, নির্বাচন কমিশন সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে চায় কেন? এটিতো গণতান্ত্রিক অধিকার। এটি নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার ওপর এই অধিকার নির্ভর করে না। নির্বাচন কমিশন সংবিধানের কত অনুচ্ছেদ, আইনের কত ধারা অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে? দেশে কি ১৪৪ ধারা জারি করা হবে? যদি এ আদেশ-নির্দেশ অগ্রাহ্য করে কেউ সভা-সমাবেশ করেন তাহলে কী ব্যবস্থা নেবেন? কোন আইনে ব্যবস্থা নেবেন? এটি তারা কোন্ আইনে করছেন? যদি আইনের মধ্যে না করে তাহলে এটি কোন অধিকার বলে করছেন? তিনি বলেন, নির্বাচনের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে বলাটাও নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে হলে সেটি আইনের দ্বারা করতে হবে। এখানে কোন আইনে সরকার তথা ইসি এ সিদ্ধান্ত নিলেন? কোথা থেকে তারা এটি পেলেন যে নির্বাচনের পক্ষে হলে সভা-সমাবেশের অনুমতি পাবেন বিপক্ষে হলে পাবেন নাÑ এটি তারা কোথা থেকে পেলেন? সভা-সমাবেশের অনুমতিই বা নিতে হবে কেন? ইসির এমন সিদ্ধান্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। নাগরিক অধিকার হরণ। এটি সংবিধানবিরোধী তো বটেই, নির্বাচনবিরোধী সভা-সমাবেশ করা যাবে কি যাবে না এ আইন কোথায় আছে? পুলিশকে বেআইনি নির্দেশ দিচ্ছেন। পুলিশ কোন আইনে এ ব্যবস্থা নেবে? ইসি পুলিশের ওপর বেআইনি নির্দেশ চাপিয়ে দিচ্ছে। যা দ্বারা নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে। বেআইনি নির্দেশ প্রতিপালনে পুলিশ বাধ্য নয়। পুলিশ যদি পালন করে তাহলে পুলিশও আইন ভঙ্গ করল। এ আদেশ তো মার্শাল ল’র অধীনে নির্বাচন করার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।

এদিকে আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়া সভা-সমাবেশ করা যাবে না, নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেছেন, ইসি কি দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছে? দেশে কে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে? যেখানে জরুরি অবস্থা জারি হয়নি, সেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার কীভাবে স্থগিত থাকবে? এ ক্ষমতা ইসির নেই। ইসির এই তুঘলকি আদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গতকাল বুধবার ব্যারিস্টার খোকন বলেন, নির্বাচন করার যেমন অধিকার আছে, তেমনি নির্বাচন বর্জন করারও অধিকার রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। আমার মনে হয়, নির্বাচন কমিশনের যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা সংবিধান খুলেও দেখেন না। যদি খুলে দেখতেন তাহলে এ ধরনের তুঘলকি আদেশ জারি করতে পারতেন না। আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের প্যাকেজে যেসব দল অন্তর্ভুক্ত তাদের জন্য ইসির আদেশ প্রযোজ্য। আন্দোলনরত বিএনপি ও সমমনা দলের জন্য ইসির এ চিঠি প্রযোজ্য নয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা অংশগ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগই ঠিক করছে কারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবে, কারা ডামি প্রার্থী হবে। এটা একটা বাকশাল মার্কা নির্বাচন।

এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়া কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ না করার নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা থেকে সবাইকে বিরত রাখতে স্বরাষ্ট্রু মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। ইসির উপ-সচিব মো. আতিয়ার রহমানের স্বাক্ষরে এ চিঠি পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে। এর বরাত দিয়ে গতকাল বুধবার পুলিশ প্রধানকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

https://dailyinqilab.com/national/article/623741