বৈধ অস্ত্রের হিসাব থাকলেও দেশে কি পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র আছে তার সঠিক হিসাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ কোনো সংস্থার কাছে নাই। দেশে চোরাচালানের মাধ্যমে কি পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করেছে সেটিও জানা নেই। সীমান্ত পার করে চোরালানের মাধ্যমে দেশে আসা অবৈধ অস্ত্র গোপনে কার কার হাতে চলে যায় সেটিও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ জানে না। সঠিক তথ্য না থাকায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। ক’দিন পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ইতিমধ্যে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার শুরু করে দিয়েছে পুলিশ, ডিবি ও র্যাব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের আগেই কদর বাড়ে অবৈধ অস্ত্রের। প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে ভয়ভীতি দেখানো, পেশিশক্তি প্রদর্শন, খুনখারাবি, ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা কাজেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে প্রার্থীদের কেউ কেউ পেশাদার ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে নির্বাচনে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। আর সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে দেশ-বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। সক্রিয় হয়েছে কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাদের অনুসারীরা বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় নেতাদের ছত্রছায়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাদের আনাগোনা বেড়েছে। গত কয়েক মাসে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই জামিনে মুক্ত হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে তারা বড় ধরনের ভূমিকা রাখার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অবৈধ অস্ত্রের সঠিক হিসাব না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে পারবে। নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। না হলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া অবৈধ অস্ত্রের প্রভাবে নিমিষেই অগণতান্ত্রিক রূপে পরিণত হতে পারে। কারণ নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হবে না এটা বলা কঠিন। সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধমূলক একাধিক কর্মকাণ্ড করা হয়েছে। নিরীহ পথচারী নিহতের ঘটনাও ঘটেছে। অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্রের যাতে অবৈধ ব্যবহার না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
পুলিশের বিশেষ শাখার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ও আগ্নেয়াস্ত্র আছে ৫০ হাজার ৩১০টি। লাইসেন্সধারীদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা রয়েছেন। ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র আছে ৪৫ হাজার ২২৬টি। এগুলোর মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে। সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে আছে ২ হাজার ৫৭৮টি এবং অন্যান্য নেতাকর্মীর কাছে ৭৯টি বৈধ অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩টি, শটগান ৫ হাজার ৪৪৪টি, বাকিগুলো দোনলা বন্দুক, রিভলভার ও রাইফেল। বিভাগভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের ১৪ হাজার ৬৮৩টি লাইসেন্স রয়েছে ঢাকা বিভাগে। সবচেয়ে কম ২ হাজার ১১৮টি ময়মনসিংহ বিভাগে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সদর দপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরের ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশ থেকে ৬৪২টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় ৩১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে ১ হাজার ৩৯৪, ২০২১ সালে ৮৪৬ ও ২০২০ সালে ৬৯৮টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে সংস্থাটি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তর জানিয়েছে, নভেম্বর পর্যন্ত দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে ৪৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫৭টি বিভিন্ন ধরনের বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশও চলতি বছরে ৭৩টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই ৩ মাসে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ১ হাজার ৩৩৫টি। এসব অস্ত্রের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৩৬০টি ও অন্যান্য অস্ত্র আছে ৯৭৫টি। অথচ এর আগে এপ্রিল, মে ও জুনে উদ্ধার করা হয়েছিল ১ হাজার ৪৫০টি অস্ত্র। আগের ৩ মাসের তুলনায় পরের ৩ মাসে ১১৫টি অস্ত্র কম উদ্ধার করা হয়েছে। অক্টোবর মাসে উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ১৯২টি। ২০২২ সালে উদ্ধার হয়েছিল মোট ৫ হাজার ৮৭৯টি। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব খুনের বেশির ভাগই ঘটে ঢাকা, গাজীপুর, ফরিদপুর, কুড়িগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায়।
জাতীয় নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা দেয়া নিয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা দেয়নি নির্বাচন কমিশন। তবে নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক আগে বৈধ অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। বৈধ অস্ত্র নিয়ে কিছু না বললেও নির্বাচন কমিশন গত ৩রা ডিসেম্বর অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের নির্দেশনা দিয়েছে।
এদিকে, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের শঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভারতের মণিপুর রাজ্যে কয়েক মাস আগে ৬ হাজার অস্ত্র লুট নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশে। এসব অস্ত্রের মধ্যে ২ হাজার উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে লুট হওয়া কয়েক হাজার অত্যাধুনিক অস্ত্র সেখানকার সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। এ ছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়াতে চোরাকারবারিরা বিভিন্ন কৌশলে অস্ত্র আনছে। এসব দিক বিবেচনা করে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশের পুলিশ সুপারদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও ডিবি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর মানবজমিনকে বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা পুলিশের রুটিন কাজ। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা বেশি জোর দিয়েছি। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার পর সারা দেশের সব ইউনিটকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বলা হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকার পুলিশ সুপারদের সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে।