১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৫:০৪

লাখ লাখ মানুষ গ্রহণ করছেন দূষিত অক্সিজেন ৪ কিলোমিটার এলাকার বাতাস বিপজ্জনক 

হক্কানী করপোরেশন লিমিটেড’র পোল্ট্রি ফিড কারখানার দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত ধোঁয়ায় কর্ণফুলী উপজেলার পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া ও দুর্গন্ধ বাতাসে মিশে মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন। বায়ু দূষণে ওই এলাকার বাতাস বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। গত ৯ বছর ধরে এখানকার মানুষ নির্মল বায়ুর নিশ্বাস নিতে পারেনি। মানুষের শরীরে বিষাক্ত বায়ু ঢুকে নানান রোগ-বালাই সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে এখানে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক জনস্বাস্থ্যঝুঁকি। ২০১৫ সালে কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটার মইজ্যারটেক এলাকায় গড়ে তোলা হয় জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এ ফিড কারখানা। এ কারখানার সামনে কোনো সাইনবোর্ড নেই। আছে জমি মালিকের সাইন বোর্ড। এতে বলা হয়েছে এ জমির মালিক মুছা সওদাগর। কারখানার সামনে সিসি ক্যামরা আছে বলে সাইনবোর্ড দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এ কারখানা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয় লোকজন। তারা বলছেন এ কারখানার দুর্গন্ধে এখানে বসবাস করা কঠিন হয়েছে পড়েছে। অনিরাপদ অক্সিজেন গ্রহণ করছেন তারা। এতে তারা বিভিন্ন রোগে ভোগছেন। আন্দোলনের মুখে কারাখানাটি ৩ মাসের মধ্যে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ সেই কথা রাখেনি। বর্তমানে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। 

দিনের বেলায় কম পরিসরে ও রাতের বেলায় পুরোদমে কারখানায় উৎপাদন করা হয়। কারখানায় পণ্য উৎপাদনের সময় ব্যাপক দুর্গন্ধ ছড়ায়। দিনের বেলায় দুর্গন্ধ একটু কম থাকে। রাতের বেলায় এত বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায় যে-দোকান, বাসা-বাড়িতে মানুষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রাত যত গভীর হয় দুর্গন্ধ তত বাড়ে। এসময় বাসা-বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হয়। বাসা-বাড়ির দরজা- জানালা একটু খুললে বাতাসের সঙ্গে দুর্গন্ধ ঢুকে যায়। বাতাসের গতিবেগে চতুর্দিকে অন্তত চারগ্রামের ৪ কিলোমিটার এলাকায় এই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এতে চরপাথরঘাটা, শিকলবাহা, চরফরিদ ও চরলক্ষ্যা গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের শরীরে এই বিষাক্ত বায়ু প্রবেশ করছে। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী-শিশু ও সংবেদনশীল মানুষ। স্থানীয় লোকজন ছাড়া দূষিত বায়ু গ্রহণ করছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষ। মইজ্যারটেক হয়ে চলাচল করেন তারা। চট্টগ্রাম শহরে আসা-যাওয়ার সময় পথে তারা এই দুষিত বায়ু গ্রহণ করেন। শহর থেকে শাহ আমানত তৃতীয় সেতু পার হতেই ওই কারখানার দুর্গন্ধ নাকে আসে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে শহরে আসার সময় কলেজ বাজার পার হতেই কারখানার দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। ট্যানারি ও বিভিন্ন বাজারের মাছ ও হাঁস-মুরগির উচ্ছিষ্ট দিয়ে মুরগির ফিড তৈরির পাউডার ও তৈল উৎপাদন করা হয়। ফিড তৈরির এসব কাঁচামাল কারখানায় আসে গভীর রাতে। এসয়ম পচা-দুর্গন্ধে মইজ্যারটেক ও আশপাশ এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের ফলে হৃদরোগ, ফুসফুস ক্যানসার, নির্ধারিত সময়ের আগে শিশুর জন্ম, কম ওজনের শিশুর জন্ম, মৃত শিশু প্রসব, মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা, শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশজনিত স্বাস্থ্যসমস্যা ও অপমৃত্যু হতে পারে। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে সংবেদনশীল গ্রুপ, যেমন শিশু, বৃদ্ধ ও যাদের আগে থেকে শ্বসনযন্ত্র-সম্পর্কিত রোগ, হৃদরোগ ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশুরা। বায়ুদূষণ একটি নীরব ঘাতক এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের মাধ্যমে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। দেশে ২০১৯ সালে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা গেছেন। এছাড়া ওই কারখানার যাবতীয় বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কারখানার পিছনে খালে। খালের পানির সঙ্গে মিশে এসব বর্জ্য চলে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে জীব-বৈচিত্র্য। চলতি বছর এ কারখানার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালিয়ে দু’বারে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। জরিমানা দিয়ে কারখানা চালু রাখা হয়েছে। কারখানা বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কারখানার সঙ্গে রয়েছে ৫০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত চরপাথরঘাটা হামিদিয়া বাগদাদিয়া হেফজখানা, এতিমখানা, মাদ্রাসা ও মসজিদ। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্ররা। এ কারখানা বন্ধের দাবি জানিয়ে মইজ্যারটেক এলাকায় মানববন্ধন করেছে তারা। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও সরকারি বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিয়ে তারা কোনো ফল পায়নি। মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আতাউল্লাহ বলেন, আমাদের কষ্টের শেষ নেই। মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিম ও হেফজখানার দরজা-জানালা ২৪ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয়। গভীর রাতে এতবেশি দুর্গন্ধ ছড়ায় যে, দম বন্ধ হয়ে আসে। ফজরের নামাযের জন্য ঘুম থেকে উঠতে হয়। তার আগে হেফজখানার ছাত্রদের ক্লাস শুরু হয়। তখন শ্বাস নেওয়া-নিঃশ্বাস ফেলা অনেক কষ্টদায়ক। মানববন্ধন ও বিভিন্ন জায়গায় দরখাস্ত দিয়ে কোনো লাভ হয়নি। এই অবিচারের বিচার একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দিলাম। চরফরিদ আহমদ আলী তালুকদার জামে মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা নজরুল এহসান জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এ কারখানা বন্ধের দাবি জানিয়ে বলেন, এ কারখানা সারাদিন দুর্গন্ধ ছড়ায়। বেশি ধোঁয়া ও দুর্গন্ধ বের হয় ফজরের নামাযের সময়। এ কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া ও দুর্গন্ধে পুরো এলাকার বাতাস অনিরাপদ। এই দূষিত অক্সিজেন আমরা গ্রহণ করছি। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে এ কারখানা বন্ধের দাবি জানান তিনি। চরপাথরঘাটা হামিদিয়া বাগদাদিয়া শাহী জামে মসজিদের সেক্রেটারি মো. ফররুখ আহমদ বলেন, এ কারখানার পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। এসময় ৩ মাসের মধ্যে কারখানাটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল মালিক কর্তৃপক্ষ। যেহেতু তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সেহেতু কারখানাটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত রাত ১১ থেকে ৩টা পর্যন্ত উৎপাদন করার কথা ছিল। এখন তিনি দিনেরাতে উৎপাদন করছেন। কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া দূরে থাক, তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। জানতে চাইলে কারখানার পরিচালক শাহ মোহাম্মদ একরাম বলেন, ২০১৫ সালে এ কারখানা স্থাপন করা হয়। তখন দুর্গন্ধ রিমুভ করার প্লান ছিল না। এসময় পরিবেশ অধিদফতর থেকে মেন্ডাটরি দেওয়া হয়। এ কারখানার প্যারালাল প্লাণ হচ্ছে বায়োফিল্টার ও ডিওডোরাইজার। দুর্গন্ধ না ছড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডিওডোরাইজার ও বায়োফিল্টার প্লাণ সেখানে বসানো হয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকক ও ইউরোপসহ পৃথিবীর যেসব দেশে এ ধরনের কারখানা আছে। সেখানে  ডিওডোরাইজার ও বায়োফিল্টারের মাধ্যমে দুর্গন্ধ রিমুভ করা করা হয়। এসব প্লাণ না থাকলে সেখানে ২ সেকেন্ডও অবস্থান করা যাবে না। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী দুর্গন্ধ না ছড়িয়ে এ কারখানায় উৎপাদন করা হচ্ছে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বেকারীতে যে খাবার তৈরি হয় তা আমরা খাই। সেখান থেকেও একটি ঘ্রাণ বের হয়। একইভাবে তার কারখানা থেকেও দুর্গন্ধ নয়, ঘ্রাণ বের হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় বলে দাবি করেন তিনি। জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রামের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, এ কারখানাকে জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর থেকে সনদ দেওয়া হয়েছে। আমি তাদের কাছে বিশেষজ্ঞ মতামত চেয়েছি। এ ধরনের ফিড করা যায় কিনা। এটা জানা খুব জরুরি। এটা জানলেই বাকিটা আমরা করতে পারব। চট্টগ্রাম জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এ কারখানাকে সতর্ক করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের এক বছরের জন্য সনদ দেওয়া হয়। পরিবেশ বিঘিœত হলে অথবা সনদের শর্ত ভঙ্গ হলে এসব কারখানার সনদ নবায়ন করা হয় না। কারখানার নীতিমালার মধ্যে রয়েছে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসব কারাখানা করা হবে না।

https://www.dailysangram.info/post/543197