১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:২১

ন্যূনতম সুদহার তুলে দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক

ক্ষুদ্র আমানতকারী ও পেনশনাররা বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা

 

বর্তমান বাজারে সবধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে। মানুষ যে পরিমাণ আয় করছে ব্যয়ের সাথে কোনোভাবেই তা মেলাতে পারছে না। প্রয়োজনীয় কেনাকাটা কমিয়ে তা সমন্বয় করা হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা কবচ হিসেবে পরিচিত ব্যাংকিং খাতের ন্যূনতম সুদহার তুলে দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হচ্ছে ঋণের বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা প্রবর্তন করায় এ সুদহার তুলে দেয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত রেখে যে পরিমাণ মুনাফা বা আয় পেত তা আরো কমে যাবে। বিশেষ করে অবসরে যাওয়া পেনশনাররা বেকায়দায় পড়ে যাবেন।

জানা গেছে, আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও ব্যাংকিং খাতে দায় সম্পদের ভারসাম্যহীনতা রোধকল্পে তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদে ব্যক্তি পর্যায়ে আমানত, বিভিন্ন প্রভিডেন্ড ফান্ড ও পেনশনারদের তহবিলের জন্য ন্যূনতম সুদহার বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়েছিল এসব আমানতের ন্যূনতম সুদহার মূল্যস্ফীতির নিচে নামানো যাবে না। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সুরক্ষা কবচ হিসেবে ন্যূনতম এ সুদহার তুলে দেয়ায় অনেকেরই মুনাফা কমে যাবে বলে মনে করছেন। গতকাল একটি নির্দেশনা পরিপালনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অক্টোবরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৩ শতাংশ। নভেম্বরে সামান্য কমে হয়েছে ৮.৮৫ শতাংশ। যদিও বাস্তবে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামই বেড়ে গেছে। সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর আগে ন্যূনতম সুদহার বেঁধে দিয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকের নির্বাহীদের ওপর বরাবরই বেশি মুনাফা করার চাপ বেশি থাকে। এ কারণে তারা আমানতকারীদের কম মুনাফা দিয়ে বেশি মুনাফা করার একটি প্রবণতা থাকে। আর এ কারণেই ২০২১ সালের ৮ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ন্যূনতম সুদহার বেঁধে দিয়েছিল। ওই সময় বলা হয়েছিল, আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং ব্যাংকিং খাতে দায়-সম্পদ এর ভারসাম্যহীনতা রোধকল্পে ৩ মাস ও তদূর্ধ্ব মেয়াদী আমানতের ওপর সুদ/মুনাফা হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বলা হয়েছিল, ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসরোত্তর পাওনাসহ বিবিধ পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিল বাবদ রক্ষিত যেকোনো পরিমাণ মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ/মুনাফা হার মূল্যস্ফীতি হার অপেক্ষা কোনোক্রমেই কম নির্ধারণ করা যাবে না। আমানতের ওপর কোনো নির্দিষ্ট মাসে সুদ/মুনাফা হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওই মাসের অব্যবহিত তিন মাস পূর্বের মূল্যস্ফীতি হারকে (বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ১২ মাসভিত্তিক গড়) বিবেচনায় নিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনায় আমানতকারীরা লাভবান হয়েছিল। কিন্তু আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করায় আমানতের সুদহারের এমন নির্দেশনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তুলে দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পড়ে এক বছরে ব্যাংকে রাখা টাকার ক্রয়ক্ষমতা যতটুকু কমছে সে পরিমাণ মুনাফাও বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে লোকসানে পড়ছেন আমানতকারীরা। এর উপরে এক্সসাইজ ডিউটি (আবগারি শুল্ক) ও অন্যান্য চার্জের খড়গ তো আছেই। এমনি পরিস্থিতিতে সাধারণ গ্রাহকের আমানত পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় না হলে প্রকৃতপক্ষে আমানতকারীরা ব্যাংকে অর্থ রেখে মূলধন হারাবেন। তারা বাড়তি মুনাফার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করলে অর্থনীতির জন্য মোটেও সুখকর হবে না।

ক্ষুদ্র আমানতকারীসহ অন্যান্য আমানতকারীদের একটি অংশ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের সুদ/মুনাফার ওপর নির্ভরশীল। ব্যাংকে রক্ষিত মেয়াদি আমানতের ওপর মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম হারে সুদ/মুনাফা প্রদান করলে আমানতকারীদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। ফলশ্রুতিতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তা ছাড়া মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ/মুনাফা হার অত্যধিক হ্রাস জনসাধারণের সঞ্চয় প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে। ফলে আমানতকারী কর্তৃক তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ খাতসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে। উল্লেখ্য, ব্যাংক-তহবিলের প্রধান উৎস হলো বিভিন্ন ধরনের আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানত। আমানতের ওপর সুদ/মুনাফা হার অতিমাত্রায় হ্রাস পেলে ভবিষ্যতে ব্যাংকের আমানতের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। ফলে ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থ্াাপনায়ও ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমানতের সুদের হার অনেক কম হলেও তাদের ওখানে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চলে। অর্থনীতি সচল রাখতে বিভিন্ন পথ (টুলস) তারা ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের এখানে সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে এখানে আমানতের সুদের হার কমে গেলে তাতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এ পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারলে মানুষ বাড়িঘর কেনার মতো জায়গায় বিনিয়োগ করবে কেউ ব্যাংকে আমানত রাখবে না। এ জন্য নতুন নতুন বিনিয়োগের জায়গা খুঁজে বের করার পরামর্শ তাদের।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/798403