১০ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৯:৪১

বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করছে কেন?

 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ভয়েস অফ আমেরিকা’র ইংরেজি ভার্সনে ‘বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করছে কেন?’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম নির্যাতন, শত শত নেতার কারাদণ্ড, হাজার হাজার নেতাকে গ্রেফতার, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা ইত্যাদি বিষয়াদি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের সাধারণসম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানসহ বিশিষ্টজনদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। শেখ আজিজুর রহমান লিখিত প্রতিবেদনটি ইনকিলাব পাঠকদের জন্য বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল (বিএনপি) আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘জালিয়াতির নির্বাচনে’ অংশ নিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে দলটি। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্রপন্থী নেতাকর্মী এবং বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র মৃত’ মন্তব্য করে দেশটির বৃহত্তম বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ‘কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।’

ড. মঈন খান গত বৃহস্পতিবার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনসহ দেশের সকল স্বাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি একচেটিয়া করে রেখেছে আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমানে যে ‘সেটআপ’ রয়েছে তার অধীনে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতের কোনো উপায় নেই। এমন প্রহসনমূলক নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়াটা অর্থহীন।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী মাসের সাধারণ নির্বাচনের জন্য তার দল নয়, বরং বিএনপি-ই ছিল ‘প্রধান বাধা’। তবে তারা নির্বাচনের ‘ট্রেন’ থামাতে পারবে না। ট্রেন সময়মতো নিজ গন্তব্যে পৌঁছাবে। তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপি দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের অন্তত ৩০ জন সাবেক সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাছাড়া, জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এই নির্বাচন সফল হবে।’

ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ বলেন, বিএনপি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের একটি বড় অংশের সেটিতে সমর্থন রয়েছে, কিন্তু সে দাবি পূরণ করা হয় নি। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ক্ষমতাসীনদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতাদের জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগ এনে বিএনপি ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বয়কট করেছিল। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আওয়ামী লীগ কর্তৃক ভোট কারচুপি এবং ব্যালট-বাক্স ভর্তির ব্যাপক অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল।

বিরোধী দল এবং গণতন্ত্রপন্থী কর্মীরা আসন্ন নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার প্রেক্ষিতে অন্যান্য দেশসমূহ ০৭ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য হাসিনা সরকারকে অনুরোধ করতে শুরু করে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন কর্তৃপক্ষ জানায় যে তারা বাংলাদেশে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেক্ষুন্ন করার’ জন্য জড়িত বাংলাদেশিদের উপর ‘ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিতে’ শুরু করেছে।

জনগণের ভোটের অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত বছর থেকে বিএনপি হাসিনার পদত্যাগ এবং নির্বাচনকে ঘিরে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ করেছে। বিরোধী দলের মতে, এগুলো (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে।
শেখ হাসিনা সরকার বিএনপির ওই দাবিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, তার দল সবসময় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতায় এসেছে।

শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ না করায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় বিএনপি নির্বাচন থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, মিথ্যা মামলা দায়ের করে সরকার গত সপ্তাহগুলোতে বিএনপির প্রায় সব সিনিয়র নেতা এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে শত শত নেতাকর্মীকে ওই সময়ে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। এভাবে গ্রেপ্তার এবং দোষী সাব্যস্ত করা- আমাদের দলকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রেরই অংশ যাতে বিএনপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করতে না পারে। তিনি বলেন, প্রতিপক্ষের (বিএনপিসহ সমমনা দল) জন্য কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, বিরোধী কর্মীরা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। আমাদের প্রাথমিক তদন্তে অপরাধের সাথে জড়িত বলে প্রমাণিত হওয়ার পরেই কেবল আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছি। সকল মামলাই আইন মেনে দায়ের করা হয়। আমরা সবসময় আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করি।

২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতি মেয়াদে ওই পদে থাকাকালীন সকল প্রকার ভিন্নমত বা রাজনৈতিক বিরোধিতার বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপের দ্বারা ক্রমবর্ধমানভাবে চিহ্নিত হয়েছেন।
গত ২৬ নভেম্বরের এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপকে ‘সহিংস স্বৈরাচারী ক্র্যাকডাউন’ বলে অভিহিত করেছে।

এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার ওই প্রতিবেদনে বলেছেন, সরকার কূটনৈতিক অংশীদারদের কাছে দাবি করছে যে তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আবার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ একই সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধীদের দিয়ে কারাগারগুলো ভর্তি করছে।

রাজনৈতিক বিরোধী দলকে ‘নির্মূল’ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান বিএনপির ছাত্র সংগঠন- ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলছিলেন, বিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরাও পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের আন্দোলনকে চূর্ণ করতে সরকার সর্বাত্মক আক্রমণ চালাচ্ছে।

সম্প্রতি নতুন (রাজনৈতিক) দলগুলোর উত্থানের জন্য আওয়ামী লীগ কঠিন নিরীক্ষার মধ্যে পড়েছে - যেগুলো বাংলাদেশে ‘কিংস পার্টি’ নামে পরিচিত - যাদের বিরোধী দল বলে মনে হলেও তারা আওয়ামী লীগের স্বার্থেই কাজ করে।

ড. আলী রীয়াজ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলছিলেন, ‘বিভিন্ন ব্যক্তি এবং দলকে নির্বাচনে যোগদানের জন্য প্রলুব্ধ ও বাধ্য করা এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের আমেজ দেওয়ার জন্য ডামি প্রার্থীদের দাঁড় করানো এই ইঙ্গিত দেয় যে ০৭ জানুয়ারি একটি পরিকল্পিত নাটক মঞ্চস্থ হবে।’ তিনি বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার জন্য আওয়ামী লীগ একটি ছক কষেছে। গত ৬ সপ্তাহে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সহ ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, গত তিন মাসে বিদ্যুৎ গতিতে ৮০০ জনেরও বেশি নেতাকর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করা (বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড) এবং পুলিশ কর্তৃক ঢাকাস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে দলের ৫৬টি কার্যালয় সিলগালা করা এই চক্রান্তেরই সাক্ষ্য বহন করে। এ সমস্ত তথ্য এই ইঙ্গিতই দেয় যে, ক্ষমতাসীন দল কেবল শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়াই নয়; নিজেদের হাতে বাছাই করা দল এবং ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন করতে চায়।
ঢাকা ভিত্তিক গণতন্ত্রপন্থী গ্রুপ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর প্রতিষ্ঠাতা ড. সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, এটা এখন ‘নিশ্চিত’ যে ০৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে একতরফা, ‘কারচুপিপূর্ণ’ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, পক্ষপাতমূলক নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করে, আমলাতন্ত্র ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে রাজনীতিকরণ করে এবং অন্যান্য সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে দখলের মাধ্যমে সরকার এই কারচুপির কাজটি করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেবল দুটি বড় ব্র্যান্ডের রাজনৈতিক দল। এর একটি আওয়ামী লীগ অন্যটি বিএনপি। সুতরাং, নির্বাচনী ময়দানে বিএনপির অনুপস্থিতিতে, কিংস পার্টি ও অন্যান্য প্রান্তিক দলগুলোর পাশাপাশি নিজস্ব ডামি প্রার্থীদের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে জিতবে তাতে সন্দেহ নেই। এ ধরনের একতরফা, কারচুপির নির্বাচন নতুন সরকারের জন্য গুরুতর বৈধতার সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে এবং সেটা অর্থনৈতিক মন্দারও কারণ হতে পারে।

https://dailyinqilab.com/national/article/622750