১০ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৯:৪০

কেন দুর্ভিক্ষ হয়?

 

খাদ্যের সংকট। মানুষের মৃত্যু। লাশের সারি। এ অভিজ্ঞতা এ ভূমে একেবারে নজিরবিহীন নয়। তবে বহুকাল হলো সেইসব দিন পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। অনাহারের সেই পুরনো চিত্রও নেই বললেই চলে। তবুও দুর্ভিক্ষের আলোচনা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে।  দুর্ভিক্ষ নিয়ে সম্ভবত ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাটি করেছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। বাংলাদেশের ’৭৪- এর দুর্ভিক্ষও ছিল তার গবেষণার অন্যতম বিষয়। অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, শুধু খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ হয় না।

সুষম বণ্টনের বিষয়টিও জড়িত এর সঙ্গে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটি দেশের অর্থনীতি কীভাবে চলবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে সরকারের নীতি কৌশলের ওপর। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি বা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের নীতি কৌশলের ভূমিকাই প্রধান। বিরোধী দলের এখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ কোথায়? বিরোধী দল দুর্ভিক্ষ আনতে পারে না। 

কেন দুর্ভিক্ষ হয় এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এত নিচে নেমে আসে যে, প্রয়োজনীয় জিনিসও মানুষ ক্রয় করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যাদের ক্রয়ক্ষমতা আছে তাদের জন্যও সমস্যা হয়ে যায়। তৃতীয়ত, খাদ্যদ্রব্য থাকার ফলেও গুদামজাত করা হয়। এই তিন কারণে মূলত দুর্ভিক্ষ হয়। আরেকটা কারণ হচ্ছে যখন এক স্থানে দুর্ভিক্ষ হয় তখন মানুষকে সহযোগিতা করার যে চেষ্টা সেটার অভাব। দেশের অনেক আইসোলেটেড এলাকা যেখানে দুর্ভিক্ষ হয় কিন্তু সহযোগিতা পৌঁছায় না। এই কারণগুলোই দুর্ভিক্ষের কারণ। মডার্ন যুগে দুর্ভিক্ষ হওয়াটা ডিফিকাল্ট। সরকারি বা সামাজিক সাহায্য কিংবা দেশের বাইরে থেকেও সাহায্য চলে আসে। তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গে ঝামেলা ছিল। বিশেষ করে দরিদ্র এলাকা কুড়িগ্রামে। সেখানেও কিন্তু আগের মতো অভাব নাই। এখন একটা পলিটিক্যাল অনিশ্চয়তা আছে। কিন্তু বাজারে অনেক সময় দ্রব্য থাকার পরও মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। মজুত করা হচ্ছে, গুদামে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে। এটার জন্য খাদ্যদ্রব্যের এক্সেস পাওয়া যাচ্ছে না। এটা যদি ব্যাপক আকারে হয় তবে একটা শঙ্কা রয়েছে। বিরোধী দল কখনো কি দুর্ভিক্ষ আনতে পারে। এই প্রশ্নের জবাবে

তিনি বলেন, না এটা সম্ভব না। তবে রাজনৈতিক কারণে কোনো জায়গায় ট্রান্সপোর্ট আটকে যেতে পারে। কিন্তু দিনের পর দিন হবে না। সেটাকে রুখে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান আছে। ’৭৪ সালে যেটা হয়েছিল সেটা হঠাৎ করে হয়েছিল। তখন যে খাদ্যদ্রব্য ছিল না তা নয়। তখন এক্সেস ছিল না। বেসরকারি সংস্থাগুলো যেতে পারতো না। সময়মতো রেসপন্স করতে পারে না। দেশে যদি মহামারি হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থা হয় যে, জায়গা মতো পণ্য যেতে পারছে না। যেমন গাজায় যেতে পারছে না। সেরকম অবস্থা তো বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সৃষ্টি করা সম্ভব না।

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মীর্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দুর্ভিক্ষ হয় খাদ্য সরবরাহ চাহিদার সঙ্গে পর্যাপ্ত না হলে। সরবরাহ থাকলে দেখতে হবে মূল্যস্থিতি কী রকম। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়সীমার মধ্যে আছে কিনা। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যে সার্ভেতে বলা হচ্ছে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দুর্ভিক্ষের সংজ্ঞাতে বলা হয়েছে, গণহারে যখন মৃত্যু হয় বা ইত্যাদি হয় তখন দুর্ভিক্ষ হয়। আমি এই মুহূর্তে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছি না। আমার মনে হয়, দেশের উৎপাদন একেবারেই খারাপ না। দেশে প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানিও করতে পারবে। সেটার জন্য বিদেশি সাহায্যও পাওয়া যাবে। রেমিট্যান্স থেকেও অর্থ আসবে। আমার মনে হয়, দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না। আমাদের সোশ্যাল সাপ্লিমেন্ট আছে সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। যাতে যাদের প্রয়োজন তারাই সাহায্য পায় এই বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের চারটি সিনট্রোম আছে। যেগুলো দুর্ভিক্ষ কিনা তা বলতে পারবো না। আমরা লক্ষ্য করলাম সার্ভে বলছে, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নতুন করে দারিদ্র্য তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত মূল্যস্ফীতি আছে কিন্তু প্রকৃত মজুরি কমছে। প্রাইজ বেড়েই যাচ্ছে কিন্তু রিয়েল ওয়েজ বাড়ছে না। তার মানে ইনকাম ইরোশন হচ্ছে। অন্যদিকে তার কনসামশন ক্যাপাসিটি কমে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, আমাদের এসইউ বলে আমাদের হাংগার অনেক। প্রোভার্টি যেভাবে কমছে হাংগার সেভাবে কমছে না। খাদ্যের ক্ষেত্রে হাইপ্রাইজ ভেলোসিটি থাকে। যারা সংশ্লিষ্ট তারা কন্ট্রাক করে দাম বাড়িয়ে দেয়। চতুর্থত, খাদ্য নিরাপত্তার যে পলিসি। খাদ্য সাপ্লাইগুলো ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। ডাইভারসিফাই হয় নাই রিসোর্সের। ভারত যদি ডিউটি বাড়িয়ে দেয়, পণ্য না দেয়- দাম বেড়ে যায়। যেটা আমরা দেখেছি মরিচ, পিয়াজ ও চালের ক্ষেত্রে। সোর্সিং অন্য কোথাও থেকে হলে এই সমস্যা হতো না।

তিনি বলেন, এই চারটা সমস্যা কিন্তু পলিসিনির্ভর। এর মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এরসঙ্গে যদি আপনি জিওপলিটিক্যাল প্লে’র অংশ হন আর জিওপলিটিক্যাল যদি প্রক্সিওয়ার হয় তখন এই চারটা কারণকে বাড়িয়ে দেবে। এগুলো ক্রাইসিসের দিকে নিয়ে যাবে।

অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ তার এক নিবন্ধে লিখেছেন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ খাদ্য ঘাটতির কারণে ঘটেনি, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। কিন্তু দুর্ভিক্ষ ঘটেছে এবং কারণটা নিশ্চয়ই খাদ্যে অভিগম্যতার সংকটে খুঁজতে হবে। এখানে অমর্ত্য সেনের একটি বক্তব্য স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছেন, খাদ্য সরবরাহ খাদ্যে অভিগম্যতা নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র পূর্বশর্ত নয়, অন্য অনেক বিষয় রয়েছে, যে জন্য  কোনো কোনো পরিবারগোষ্ঠী ও জনগোষ্ঠী প্রয়োজনীয় খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে না। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের আসল কারণ এ রকম কয়েকটি বিষয়ে নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ দেখতে হবে,  দেশে খাদ্য থাকা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ কেন প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলো। অমর্ত্য সেনের বিশ্লেষণ অনুসারে এ বিষয়ে প্রশ্ন রাখা যায়, কেন তাদের খাদ্য অভিগম্যতায় এমন পতন ঘটলো?

 

https://mzamin.com/news.php?news=87568