১০ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৯:৩১

ভেবে আরো গ্লানি বোধ করি

-সালাহউদ্দিন বাবর

 

ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, সন্দেহ নেই তিনি ক্রিকেটের খ্যাতিমান এক অলরাউন্ডার। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়েই সবাইকে অবাক করেছে। নৌকা প্রতীক পেয়ে একটা ‘মিলেমিশে’ বা রঙ তামাশার নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছেন। নিশ্চয়ই সাবেক বিএনপি নেতা মেজর শাহজাহান ওমরের (অব:) মতো জনাব সাকিবের যথেষ্ট ‘হ্যাডম’ আছে বলেই দলে যোগ দেয়ার আগেই দলের নির্বাচনী টিকিট পেতে এতটুকু কষ্ট ক্লেশ লবিং করতে হয়নি। রাজনীতিতেও তিনি নাকি অলরাউন্ডারই হবেন বলে উল্লেখ করেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের এই অলরাউন্ডার বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট করেননি। রাজনীতির স্বঘোষিত এই অলরাউন্ডার অবশ্য এই ময়দানে নেমে প্রথমেই বোল্ডআউট হয়ে গেছেন। যেমন, তিনি তার জনপ্রিয়তার ‘হ্যাডম’ দেখাতে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বহু লোকজন নিয়ে নমিনেশন পেপার জমা দিতে গিয়েছিলেন। যা বিধিসম্মত নয়। নির্বাচন কমিশনে শোকজ নোটিশের জবাবে জনাব সাকিব অকপটে তা স্বীকার করেছেন। যে প্রার্থী এই সাধারণ বিধানই জানতেন না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি সংসদ সদস্য পদের নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। অথচ সাধারণবিধিটাই জেনে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। আমাদের এই অনুমান ভুল হতে পারে। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগার হয়ে যাওয়ার পর দেশের কোনো বিধিবিধান মানা কি খুব দরকার পড়ে। তা ছাড়া তার দল আওয়ামী লীগ সব আইন-কানুন অমান্য করেই ১৫ বছর ধরে দিব্বি রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। সাকিব এসব জানেন বলে তার ‘হ্যাডম’ এতখানি। শুধু সাকিব নন, জনাব শাহজাহান ওমর কম যান কোথায়।

 

সাকিব সাহেব শুধু একাই এমন ‘হ্যাডম’ দেখিয়েছেন। সেটা ঠিক নয়। তার দলের সদস্যগণ নির্বাচন নিয়ে ‘কুছ পরোওয়া’ নেই মুডে অতীতেও থাকতেন এবং এখনো আছেন। বিশেষ করে যারাই নৌকা প্রতীক হাতে পেয়েছেন। আজ পর্যন্ত এসব প্রতীকধারীকে কখনোই ভোট নিয়ে ভাবতে হয়নি। মানুষের কাছে সমর্থন পেতে তাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়নি। তারা এও জানেন সম্মুখেও যেতে হবে না। সংসদের প্রবেশের গেট পাস তারা আগেই পেয়ে যান। নৌকায় ওঠার সাথে সাথেই তাদের ভোটকর্ম শেষ। এখন সংসদে প্রবেশের ক্ষেত্রে জনগণের হাত নয় ক্ষমতাসীনদের হাত থেকে নিতে হয়।

তবে সেই সংসদে প্রবেশ করার তাদের লক্ষ্য এমন নয়। তারা দেশ সেবার জন্য মরিয়া। তাদের মনের গহিনের বাসনাটি হচ্ছে আত্মসেবা। একাদশ সংসদের যারা সদস্য, তারা কতটুকু দেশ সেবা করেছেন। আর কতটুকু আত্মসেবা করেছেন। তার সামান্য কিছু হিসাব প্রকাশ পেয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে সেটা উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্তমান সংসদে যারা সদস্য তাদের পূর্বাপর সম্পদের ফিরিস্তি হচ্ছে। পূর্বে যা ছিল কুমিল্লার লালমাইয়ের টিলা মতো। এখন সেখান থেকে সম্পদ তিন পার্বত্য জেলার সর্বোচ্চ পাহাড়ের মতো দীর্ঘ ও স্ফীত হয়েছে। আর একাদশ সংসদের সদস্যরা রাষ্ট্রের কতটা সাশ্রয় করে গেছেন। তার খণ্ডাংশের কিছু তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে। একাদশ সংসদের সম্মানিত সদস্যদের অধিবেশনে যোগ দেয়া নিয়ে হেলা অবহেলার কোনো শেষ ছিল না। সে কারণে সংসদের কোরামের অভাবে সংসদ অধিবেশনে মিলিত হতে নিয়তই বিলম্ব ঘটে। এর ফলে রাষ্ট্রের বিপুল অঙ্কের অর্থের অপচয় হয়েছে। আগামীতে এমনই এক সংসদেরই সদস্য হতে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। এখনই তার যে হ্যাডম জনগণ দেখছে সেটা অবাক হওয়ারই মতো নয়। ইতোমধ্যে শোনা গেছে, টাকাকড়ির টানে তিনি নাকি নির্বাচন ফেলে দেশের বাইরে গিয়েছেন ক্রিকেট খেলতে। এ ছাড়া আরো অনেক ব্যবসা বাণিজ্য আছে তার। বাংলাদেশে ফ্রিস্টাইল ব্যবসা বাণিজ্য করতে যদি এমপির একটা তকমা জোগাড় করা যায়। তবে দিনে দিনে ব্যবসা বাণিজ্যের শনৈই শনৈই তরকিক আর কে ঠেকায়। আজকাল এমপি হওয়ার মতলবটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা খুব কষ্ট করে ঝুঝতে হয় না। শাসক দলের টিকিট পেলে একেবারে ‘শিয়োর শট’। কোনো মায়ের পুত্র ধনের ধড়ে কটা মাথা আছে যে সাকিব সাহেবদের ক্যাচ লুফে নিতে পারবে। এটা সাকিব সাহেব নন, তার আর সব সারথিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

যাই হোক, গভীর বেদনা নিয়ে লিখতে হচ্ছে আমাদের অনেকের প্রিয় ইবরাহিম ভাইকে নিয়ে। হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় ভাই মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) (অব:), তার সাথে আমার সখ্যতা দীর্ঘ তিন দশকের মতো। ইবরাহিম ভাইয়ের ছোট ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ ইশহাক (মরহুম) শুধু আমার অনুজ প্রতিমই ছিল না। সেই মেধাবী যুবক আমার তারুণ্যে প্রিয় সহকর্মীও ছিল। ওর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলাম বটে। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক গভীর মমতার ও বন্ধুত্বের পর্যায়ে ছিল। যাক সে কথা। নয়া দিগন্তের প্রতিটি অনুষ্ঠানে বিশেষ করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ইব্রাহিম ভাই কখনোই গরহাজির থাকতেন না। এই তো গত ২৫ অক্টোবর ’২৩ তারিখে তিনি নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে জেনারেল সাহেব যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তার কয়েকটি মাত্র চরণ প্রাসঙ্গিক কারণে উদ্ধৃত করা হলো। ‘মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে শুকরিয়া জানাই যে, আপনাদের প্রত্যেকটি ফাংশনে আসতে পেরেছি। আপনাদের জীবনের ১৯ বছর পার করেছেন। তার মধ্যে ১৭ বছর নিয়মিত আপনাদের জন্য কলাম লিখেছি। ১৯ বছর পার করেছেন এর মধ্যে বিগত ১৫ বছর না হলেও ১০টি বছর আপনাদের জন্য অনেক কষ্টদায়ক হয়েছে। এর কারণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আপনারা সাংবাদিকতার যে মূল্যবোধকে ধরে রেখেছেন সেটা বর্তমান রাজনৈতিক সরকার পছন্দ করে বলে মনে করি না। আমি স্পষ্ট ভাষায় কথা বলি, আমার বদনাম আছে আমি স্পষ্টভাষী। আবার এ সুনামও আছে আমি যুক্তি দিয়ে কথা বলি। বাংলাদেশ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একটাকে ইংরেজিতে বলা যায় সিভিল, সুশীল, শোভনীয়। আরেকটাকে বলা যায় এভিল, শয়তানি, দুর্বৃত্ত, কষ্টদায়ক। এই দুই লড়াইয়ে আপনারা আছেন ডান দিকে, সিভিল শোভনীয়, কল্যাণময়। আর অপর পক্ষে যারা আছে তারা চাইবে না আপনাদের প্রসার হোক। দিগন্তের জন্য পথটা অনেক কষ্টকর। ইবরাহিম ভাই অক্টোবরের ২৫ তারিখে আপনি ছিলেন আমাদের কল্যাণকামী। আপনি যাদের বলেছিলেন আমাদের প্রসার চায় না। মনে বড় কষ্ট নিয়ে বলতে চাই। আপনি কেমন করে আমাদের ও জাতির যারা প্রসার চায় না। তাদের শিবিরে কিভাবে যোগ দিলেন। আপনার এই মতিগতি নিয়ে এখন জাতি খুব কষ্ট পায়। আমাদের মনে হয় আপনি দুই কূলই না হারিয়ে ফেলেন। ইবরাহিম ভাই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জাতির জন্য জীবন দিতে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। এখন অনেক বলেন আজো একটা মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধেও আপনি প্রথম সারিতেই ছিলেন। কিন্তু রনেভঙ্গ দিয়েছেন। আগামীতে ইতিহাস বলে দেবে আপনি নায়ক না খলনায়ক। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমার প্রিয় ইবরাহিম ভাইকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন সব কথা বলা হচ্ছে, যা শুনতে পড়তে খুব কষ্ট হচ্ছে। মন ভেঙে যাচ্ছে।

দেশের মানুষের বড় দুঃখ। গত দুটো সংসদ নির্বাচনে তাদের পক্ষে ভোট দেয়ার মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারটুকু তারা প্রয়োগ করতে পারেনি। ৭ জানুয়ারি ’২৪ সালে যে নির্বাচন হচ্ছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ছলনার ভোটকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করবে। গণতন্ত্র শব্দটি এখন এখানে ছলনার প্রতিশব্দ বলে মানুষ মনে করে। এই অধঃগতির পথকে মসৃণ করেছে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তথা স্তম্ভ। তাদের সারথি হয়ে আছে প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক সব সংগঠন। সত্যিই আজ মনে কষ্ট, কেননা ব্যক্তির অতি ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ওই সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত। ভেবে আরো গ্লানিবোধ করি। দেশের ভুখানাঙ্গা মানুষগুলোর কষ্টের সর্বশেষ মুদ্রাটি পর্যন্ত, ওই সব ব্যক্তির আরাম-আয়েশ ও বেশভূষার জন্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের একটি মাত্র লক্ষ্য, কখনো যদি জাতির ক্রান্তিলগ্ন এসে উপস্থিত হয়। তারা সিনা ফুলিয়ে দাঁড়াবে। মনে হয় আজ সেই ক্রান্তিলগ্ন দুয়ারে উপস্থিত। কিন্তু জনতার সেই স্বপ এখন যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে উঠছে। সেই সব প্রবর স্বার্থান্বেষী মহলের পদ যুগলে শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে।

দশম ও একাদশ, এই দুই সংসদ নিয়ে। একেবারে যৌক্তিক কারণে এবং অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানের আলোকে। যত সব লজ্জাজনক বিশেষণ যোগ হচ্ছে ও সংসদ দুটো অগ্রপশ্চাতে। একটি ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন আর অপরটিকে বলছে ‘নিশিরাতে’ ভোট। একটি জনবিরল অপরটি নিশিরাত। এই দুই পরিবেশে কখনোই কোনো ভালো কাজ হয় না। এসবের সাথে অশ্লীলতার ‘বদবু’ তথা দুর্গন্ধ জড়িয়ে আছে।

এই সব অতীত নিয়ে মানুষ কিভাবে ভাবতে পারে অদূরভবিষ্যতে ভালো একটা ভোট হতে পারে। তা ছাড়া যেসব আলামত এখন লক্ষ করা যাচ্ছে যার দুটো উদাহরণ ওপরে দিয়ে, এই নিবন্ধের সূচনা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম প্রধান আগেই বলে দিয়েছেন (নির্বাচন নিয়ে) খেলা হবে, শত ফুল ফুটে। দেশবাসী দেখছেন হ্যাঁ ‘বলি খেলা’ হচ্ছে। আর কাগজের অনেক ফুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এখনো কি মানুষের বুঝতে বাকি আছে। শাসক দল ও নির্বাচন কমিশন এই দুই সারথি সমান্তরালভাবে দেশকে কোথায় এবং কোন জিনজিরে আটকে রাখতে পথ চলছে।
ndigantababar@gmail.com

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/797546