৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৬:২৯

বিমানবন্দর দিয়ে আবারও বেড়েছে স্বর্ণের চোরাচালান

যরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টম হাউজের নিজস্ব গুদাম থেকে ৫৫ কেজি ৫০১ গ্রাম স্বর্ণ চুরির ঘটনায় তোলপাড় হলেও এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। সরকারি গুদাম থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে এতবড় চুরির ঘটনা দেশের ইতিহাসে বিরল। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার ঢাকার শাহজাজাল বিমানবন্দর থেকে ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকার স্বর্ণসহ একযাত্রীকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনার একদিন পর গতকাল শুক্রবার সকালে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৩৫ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারজনকে আটক করা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণ কয়েক কোটি টাকার গায়েব এবং বড় চালানের সঙ্গে রাঘব বোয়ালরা জড়িত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। আর রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারায় স্বর্ণের চোরা চালান থামছে না। 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ করতে না পারায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গডফাদাররা এতটাই প্রভাবশালী যে, বিভিন্ন সময় চোরাচালানের ঘটনার মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তাদের পরিচয় জানার পরে তদন্তকারী কর্মকর্তারাই থমকে যান। এমনটি হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। আবার অনেক সময় তদন্তকারীদের ম্যানেজ করে আড়ালেই থাকছেন সিন্ডিকেটের মূল হোতারা। সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, অবৈধভাবে স্বর্ণ আনা এবং পরবর্তীতে সেগুলো পাচার করা ঠেকাতে হলে এমন সব শিল্পপতি ও প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন যাদের নাম শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠবে। এরা এতটাই প্রভাবশালী যে, তাদের হাতের ইশারায় বড় বড় কর্মকর্তাদের রদবদল, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতি হতে পারে।

সূত্র জানায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক বেসরকারি এয়ারলাইন্সে কতিপয় ব্যক্তিরা স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। স্বর্ণ চোরাচালান সংক্রান্ত মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়ে শঙ্কিত হয়ে যান অনেকেই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সিভিল এভিয়েশন এবং কাস্টমসের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশেই বিমানগুলোতে চলছে স্বর্ণ চোরাচালান। প্রতি বছর ৬০ থেকে ৬৫ টন স্বর্ণ দেশে প্রবেশ করছে। তবে ছোট ছোট স্বর্ণের চালান একের পর এক ধরাও পড়ছে। ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৫৭ মণ স্বর্ণবার ও স্বর্ণালংকার জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। জব্দকৃত স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রয়েছে। এর বাইরে আরও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ চোরাই পথে দেশে এসেছে এবং প্রতিবেশী দেশে পাচার হয়েছে। ওই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আনতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তার যোগানদাতারা হলেন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে পর্দার আড়ালেই থাকছেন গডফাদাররা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দুই শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের কর্মীও রয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে স্বর্ণ চোরাচালান সংক্রান্ত ৩১৮টি মামলা হয়েছে। বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের ২৬০ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু অর্থ যোগানদাতারা থাকছে অধরা। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে প্রতি মাসেই স্বর্ণ দেশে প্রবেশ করছে। আবার এসব স্বর্ণের অধিকাংশই প্রতিবেশী দেশে পাচার হচ্ছে। স্বর্ণ চোরাচালানকারী সিন্ডিকেট দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধভাবে নিয়ে আসছে এসব স্বর্ণ। বিমানবন্দরগুলোর কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও প্রতিবছর গড়ে ১৬০ থেকে ১৬৫ টন স্বর্ণ চোরাই সিন্ডিকেট দেশে নিয়ে আসছে। 

এদিকে পুলিশ জানায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টম হাউজের গুদাম বা ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি সোনা চুরির ঘটনায় করা মামলায় দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম ও মাসুদ রানার ফের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমান শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের পাঁচদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। আদালত আসামির উপস্থিতিসহ রিমান্ড শুনানির জন্য আজ দিন ধার্য করেন। এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম সাহেদ, আকরাম শেখ, মো. মাসুম রানা এবং সিপাহি মো. মোজাম্মেল হক, মো. নিয়ামত হাওলাদার, মো. রেজাউল করিম ও মো. আফজাল হোসেনের পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। এরপর সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম সাহেদ ও সিপাহি মো. আফজাল হোসেনকে আবার পাঁচদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। বাকি পাঁচ আসামি কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম শান্তা আক্তার তিনজনের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন এবং পাঁচজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। গত ২২ আগস্ট একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ঢাকা কাস্টম হাউজের বিমানবন্দর ট্রানজিট গুদামে ৫৫ কেজি সোনা পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ ছয়টি ডিটেনশন মেমোর পণ্যের হিড়েবে গরমিল। সোনা চুরির ঘটনায় কাস্টম হাউজের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে ৩ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিমানবন্দর থানায় এ মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঢাকা কাস্টম হাউজের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি ৫০১ গ্রাম সোনা খোয়া গেছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি। সাধারণত বিমানবন্দরে যাত্রীদের কাছ থেকে জব্দ করা সোনার বার, অলংকারসহ মূল্যবান জিনিস এ গুদামে রাখা হয়। গুদামে রক্ষিত সোনার হিসাব মেলাতে গিয়েই ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে।

https://www.dailysangram.info/post/542773