৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৬:২৫

রাজনৈতিক সঙ্কট ও বিপন্ন অর্থনীতি

-ইবনে নূরুল হুদা

দেশে দীর্ঘ পরিসরে চলছে রাজনৈতিক সঙ্কট। ফলে রাষ্ট্রাচারের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। আগামী দিনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করছেন তথ্যাভিজ্ঞ মহল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই সঙ্কট সমাধানের কোন কূ-কিনারা আপাতত দেখা যাচ্ছে বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনঢ় থাকার কারণে সম্প্রতি সঙ্কটের কোন সমাধান হচ্ছে না। একশ্রেণির রাজনীতিকদের অতিমাত্রায় অহমিকা ও আত্মকেন্দ্রিকতায় সার্বিক পরিস্থিতি এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের অতিমাত্রায় একগুয়েমী ও ক্ষমতালিপ্সার কারণেই পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। মূলত, দেশের নির্বাচনকে নিয়ে চলছে রীতিমত রাজনৈতিক অস্থিরতা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়ায় চলমান এই সঙ্কট একটা জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। যা বরাবরই ক্ষমতাসীনদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও যারা ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের বাইরে শক্তিগুলো রাজপথে সোচ্চার ছিলেন বা এখনো রয়েছেন। আর স্বাধীনতার পাঁচ দশক পড়েও এ সমস্যার গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান হয়নি। যা আমাদের জন্য রীতিমত দুর্ভাগ্যের।

মূলত, ১৯৮২ সালে একটি নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করার পরবর্তীতে আমাদের দেশের নির্বাচনগুলোকে লাগামহীন ভোট চুরির অভিযোগ ওঠে। আর এই চুরির অভিযোগ পরবর্তীতে ভোট ডাকাতির রূপ নেয়। ফলে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তীব্র গণআন্দোলন শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার দাবি গণদাবিতে রূপ নেয়। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে বিরোধী দলের সম্মিলিত আন্দালন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয় এবং এরশাদ কেয়াটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হোন এবং ১৯৯১ সালে সে সরকারের অধীনে অতীতে সকল সময়ের চেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যা ছিল আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য অনন্য মাইলফলক।

মনে করা হয়েছিল যে, আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে বিরোধ ও এতদসংক্রান্ত জটিলতার স্থায়ী সমাধান হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। যে রাজনৈতিক শক্তি নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি ১৭৩ দিন হরতাল পালন করেছিল তারাই আবার আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে অবাধ গণতন্ত্র ও জনণের ভোটাধিকারের রক্ষাকবজ কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেশে নতুন সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। তারা ২০১৪ সালে একতরফা এবং ২০১৮ সালে নৈশভোটের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে। সঙ্গত কারণে রাজপথের বিরোধী দলগুলো অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে। সে আন্দোলন এখন অবরোধ ও হরতালের মাধ্যমে সর্বাত্মক রূপ নিয়েছে। কিন্তু সরকার রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার করে বিরোধীদলের সেই যৌক্তিক আন্দোলন দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্ষমতাসীনতা দেশ ও জাতির কল্যাণে কথা না ভেবে শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিরোধীদের দাবি পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি এবং চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। বিষয়টি অভ্যন্তরীণ অঙ্গন পেড়িয়ে এখন বৈশ্বিক অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসলেও সে কথা ক্ষমতাসীনরা কোনভাবেই আমলে নিচ্ছে না। মূলত আমাদের দেশের চলমান ক্ষমতাকেন্দ্রীক নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই এ সমস্যার কোন সমাধান মিলছে না। আর এর সরাসরি ভিকটিম হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধী দলের চলমান লাগাতর আন্দোলনে নানামুখী চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কষ্টে আছে সাধারণ ও নিম্নবিত্তের মানুষ। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এরই মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলছে হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি। সরবরাহ বিঘ্ন হওয়ায় বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। এমন পরিস্থিতিতে সঙ্কটে থাকা অর্থনীতি আরও সঙ্কটের মুখে পড়ছে। অর্থনৈতিক এই মন্দায় বিনিয়োগে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ভরশীল। বর্তমানে অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। তীব্র ডলার সঙ্কটে এলসি করা যাচ্ছে না। কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা পুরোপুরি উৎপাদন করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে নতুন কোনো অস্থিরতা দেখা দিলে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। এর পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসনের মতো আন্তর্জাতিক সঙ্কটময় পরিস্থিতির প্রভাবও রয়েছে। আন্তর্জাতিক সঙ্কটের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সঙ্কট যুক্ত হলে শিল্পোৎপাদন, ব্যবসায়িক কর্মকা-সহ সামগ্রিক অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এসব বিষয়ে বরাবরই উদাসীন আমাদের দেশের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে একটি বৈরী পরিস্থিতি চলছে। আর এই পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ আছে। এ সব কিছুর মধ্যেও দেশ নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। যা এক ধরনের দায়িত্বহীনতার বলা যায, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী গত বুধবার বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আগে তা ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার ছিল। তবে দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলার।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার (১০ হাজার কোটি টাকা) ছুঁয়েছে। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার। বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি। বাকি ১৬ শতাংশ বা ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্বল্পমেয়াদি। ঋণ জিডিপির অনুপাত ৪২.১ শতাংশ।

গত ১০ বছরেই বিদেশি ঋণ বেশি নেয়া হয়েছে। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এই ঋণ বাড়তে থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত মোট বিদেশী ঋণ ছিল ৪৫.৮১ বিলিয়ন ডলার। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই ৪ মাসে বিদেশী ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট ১১০ কোটি ১৪ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। এ অর্থবছরের ৪ মাসে বিদেশী ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে ৩৭ কোটি ৭২ লাখ ডলার। আর এ অর্থবছরে বিদেশী ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। আগের অর্থবছরে শোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য মতে, আগামী অর্থবছরে আসল পরিশোধ করতে হবে ২৯০ কোটি (২.৯ বিলিয়ন) ডলার, যা এর পরের অর্থবছরে বেড়ে হবে ৩৩১ কোটি ডলার। ২০২৭ সাল নাগাদ এটা ৫০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে।

দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভালো ইলেকশন হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। এর জন্য একটা ভালো জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। ভালো নির্বাচন বলতে আমরা সবার অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বোঝাতে চাচ্ছি। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। আর যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হয়, তাহলে দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে। সামাজিকভাবে অস্থিরতা বিরাজ করবে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনীতি আরও দুরবস্থার দিকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তারা আরো বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি, পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যাহত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় উদ্বেগজনক হারে কমে। ফলে ডলার সঙ্কট ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছানোর আশঙ্কা থাকে। রিজার্ভের পতনে নতুন গতি পায়, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই রাজনৈতিক সংঘাত অর্থনীতিকে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেবে।

মূলত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে অন্য কোনো দেশের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী দল ও বৈশ্বিক ক্রেতারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাদের ক্রয় আদেশ এবং বিনিয়োগ পরিকল্পনাগুলো আরো সুরক্ষিত ও স্থিতিশীল এলাকায় সরিয়ে নেয়। যখন একটি বড় বৈশ্বিক ক্রেতা একটি দেশ থেকে অর্ডার স্থানান্তর করে, তখন ছোট ক্রেতারাও তাদের অনুসরণ করে। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রতিবেদনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক খাতে ২০ দিনের হরতাল ও অবরোধে আর্থিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। হরতাল ও অবরোধের কারণে দিনে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতা দেশের অর্থনীতিকে ক্রমেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে তীব্র রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। আগামী নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণযোগ্য করার জন্য নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলোর যুগপৎ ও লাগাতর আন্দোলন চলছে। কিন্তু সরকার তাদের যৌক্তিক দাবিকে পাশ কাটানোর নানাবিধ কৌশলের আশ্রয় নিলেও চলমান আন্দোলন বন্ধ হচ্ছে না বরং এর পরিসর দিনের পর দিন বাড়ছে। ফলে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন হয়ে পড়ছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। এমতাবস্থায় দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই এই অশুভ বৃত্ত থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। অন্যথায় পরিণতি কারো জন্য শুভ হবে না।

https://www.dailysangram.info/post/542759