৮ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:৪০

সগৌরবে চলিতেছে সার্কাস! সার্কাস!! সার্কাস!!!

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

 

ষাট ও সত্তরের দশকে শহরের অলিতে গলিতে, কখনও কখনও পাকা রাস্তা ধরে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে নতুন মুভির প্রদর্শনী উপলক্ষে মাইকিং করা হতো এই বলে যে, শুক্রবার রওশন টকিজে মুক্তি পাচ্ছে নাচে-গানে ভরপুর, সপরিবারে দেখার মতো ছবি বনবাসে রূপবান। বনবাসে রূপবান। সঙ্গে বিলি করা হতো হ্যান্ডবিল। আর যে রিকশায় চড়ে এসব মাইকিং করা হতো, তার পেছনে সেঁটে দেওয়া হতো ওসব সিনেমার বড় বড় পোস্টার। কখনও রঙিন, কখনও বা সাদা-কালো।

এভাবে মাইকিং করে যারা প্রচার চালাতেন, তাদের উচ্চারণে থাকতো বিশেষ ভঙ্গি। টেনে টেনে কথা বলতেন তারা। শ্রেষ্ঠাংশে কারা আছে, তাদের নামও প্রচার করা হতো, দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য। শ্রেষ্ঠাংশে আছে রোজী সামাদ, আমিন রহমান আরও অনেকে। আসিতেছে, আসিতেছে রাজ্জাক-শাবানা অভিনীত...। রিকশায় যেসব পোস্টার সাঁটা হতো সেগুলো প্রধানত থাকতো একটু খোলামেলা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিনেমার ভেতরে তেমন খোলামেলা দৃশ্য থাকতো না। কিন্তু আমরা সাইকেল ভাড়া করে থার্ড ক্লাসে টিকিটের পয়সা পকেটে নিয়ে দল বেঁধে সে সিনেমা দেখতে যেতাম অভিভাবকদের না জানিয়েই।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখন এমনই সার্কাস চলছে। বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো দাবি করছে, নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। এর কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এই সরকারের অধীনে যে দু’টি তথাকথিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কাউকে ভোট দিতে হয়নি। তাতে এমনি এমনি শূন্য বুথে ভোট দিয়ে দিয়েছিল সরকারের লোকেরা। ফলে ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদে ১৫৪ সদস্য বিনাভোটে নির্বাচিত হন। তাদের সহযোগী ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি। উল্লেখ্য ১৯৮২ সালে এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল। তারা ক্ষমতায় এসেই বিএনপিকে নির্মূল করার জন্য অভিযান পরিচালনা করেছিল। এই অপকর্মে সবসময় তাদের সহযোগী ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এরপর এরশাদ আরও দু’টি তথাকথিত নির্বাচনের আয়োজন করেন। সে নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ সহায়তায় দেশে সামরিক শাসন নয় বছর দীর্ঘায়িত করেছিলেন এরশাদ। এতে সব সময় সহযোগিতা করে আওয়ামী লীগ।

এরপর ২০১৮ সালে আরও এক তথাকথিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। তার ফলাফল দেখানো হয় ভয়ঙ্কর। এবার আর ভূতে ভোট দেয়নি। প্রশাসন আর পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আগের রাতেই আওয়ামী লীগের পক্ষে ব্যালট বাক্স ভরে রাখে। সে নির্বাচনে বিএনপিকে দেওয়া হয় মাত্র সাতটি আসন। এ নিয়ে সারা পৃথিবীতে হাসির রোল উঠে। ছিঃ ছিঃ পড়ে যায়। এই নির্বাচনী প্রহসনের পর পুলিশ বাহিনী নিজেরাই নতুন শ্লোগান তোলে, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ।’ সে ধারা অনুসরণ করতে করতে সরকার দেশকে এখন একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। পুলিশের হাতে দিয়েছে অপরিসীম ক্ষমতা। ফলে সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে এই বাহিনীর সদস্যরা। তারা জিম্মি করে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে, ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মত অপরাধ করে। ক্রসফায়ারের নামে নরহত্যা চালায়। 

আইন ভঙ্গ করে দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখায়? যেহেতু সরকার বিরোধী দল দমনে তাদের যথেচ্ছ ব্যবহার করে। গায়েবি মামলা দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হয়রানি করে থাকে। যাকে তাকে গ্রেফতার করে, আটক রেখে অকথ্য নির্যাতন চালায়। এর প্রতিকারের বদলে সরকার তাদের প্রশ্রয় দেয়। ফলে পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এখন ত্রাসে পরিণত হয়েছে।

এই তথাকথিত নির্বাচন আয়োজনে সরকার প্রথম থেকেই অনমনীয় থেকেছে। তাদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি অংশ নিক এমন একটা পক্ষপাতদুষ্ট দখলদারিত্বের নির্বাচনে। সে চেষ্টা সফল হয়নি। শুধু বিএনপি নয়, উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর চলছে হামলা-মামলার স্টীম রোলার। আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য বিরোধী দল তারা সবাই অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। সরকার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। বিরোধী দলগুলো যেসব সমাবেশ-মহাসমাবেশের ডাক দিচ্ছে, তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ যোগ দিচ্ছে। মানুষ যাতে বিরোধী দলের সমাবেশে না আসতে পারে, তার জন্য সরকার ও তার পেটোয়া বাহিনী এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুন্ডা-মাস্তান দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে। পুলিশের পাশে কেন মাস্তান বাহিনী? এর জবাবে সরকারি দল বলছে যে, মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারি দলেরও রয়েছে। ফলে দেশ এখন এক সংঘর্ষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। জনসমাবেশে আসতে বাধা দিতে, বাস-লঞ্চ ট্রেন বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ফলে দু’তিন দিন আগেই সাধারণ মানুষ বিরোধী দলের সমাবেশে যোগ দিতে সমবেত হয়েছে। পায়ে হেঁটে, নৌকায়, বাইসাইকেলে চড়ে চিড়া-গুড় নিয়ে তারা এসেছেন সমাবেশস্থলে। বিরোধী দলের সমাবেশে জনসমাগত বাড়ছেই।

এতে ভীত-সন্ত্রস্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে সরকার। এখন চলছে পাইকারি হারে গ্রেফতার। পুলিশ মামলা দেয়ার সময় গুটিকয়েক নাম দিয়ে অজ্ঞাত আরও শত শত মানুষের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দায়ের করছে। নতুন পুরানো মামলায় প্রতিদিন শত শত বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দুই বছরের অধিক মেয়াদে সাজা দিচ্ছে। এসব ব্যবস্থার লক্ষ্য বিরোধী দলগুলোকে দৌড়ের ওপর রাখা। সংবিধান অনুযায়ী, আদালত কাউকে দুই বছর বা তার বেশি মেয়াদে সাজা দিলে তিনি আর পরবর্তী পাঁচ বছর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তাই সাজা দেয়া হচ্ছে আড়াই বছর বা তার বেশি মেয়াদে।

এসবের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সরকার বিরোধী রাজনীতি বন্ধ করতে চাইছে। গত এক মাসে বিএনপির বিশ হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দেয়া হয়েছে। পাইকারিভাবে সাজা দেয়া হচ্ছে। বিএনপি জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতা এখন কারাগারে। ৪২ হাজার ধারণ ক্ষমতার কারাগারগুলোতে এখন বন্দীর সংখ্যা ৯০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিএনপি চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত নেতাকর্মীরা এখন কারাবন্দী। জামায়াতের অবস্থাও তাই। সরকার দাবি করে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ তাদের পক্ষে রয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে তাদের ভয়ের কী আছে। কারণ সরকার বাকোয়াজি করুক না কেন, তারা গোয়েন্দাদের মাধ্যমে জানে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ৩০টি আসন পাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। সুতরাং ছলে-বলে-কলে-কৌশলে তারা জন-আকাক্সক্ষার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে।

এই নির্বাচনি সার্কাসে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে- এটা দেখানোর জন্য নির্বাচন কমিশন বহুসংখ্যক নামসর্বস্ব নবগঠিত কিংস পার্টিকে নিবন্ধন দিয়েছে। ঠুঁটো জগন্নাথ নির্বাচন কমিশন সরকারি বাদ্যের তালে নাচছে। সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা বিরোধীদলের প্রতি অসৌজন্যমূলক ভাষা ব্যবহার করে বক্তব্য দিচ্ছে। আওয়ামী সন্ত্রাসে আহত দলনেতাদের টিটকারি করছে, উনি কি ইন্তিকাল করেছেন? কিংবা বিরোধীদলের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সমালোচনা করে বলছেন, ‘কেউ যদি নির্বাচনে অংশ না নিতে চায়, তবে কি তাকে কোলে করে নিয়ে আসতে হবে?’ 

https://www.dailysangram.info/post/542681