৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৬:৪৬

নতুন কারিকুলাম ও প্রাইভেট স্কুল নিবন্ধন

-খান মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী

 

টেলিভিশন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললে কেবলই অভিভাকদের আহাজারিÑ আলু ভর্তা আর ডিম ভাজা শিখাতে কারি কারি টাকা ব্যয় করে স্কুলে কেনো সন্তানদেরকে পড়াতে হবে? এসবতো আমরা বাড়িতেই শিখাতে পারি। সংগীত, নৃত্য, সেলাই করা আর সাইকেল চালানোই ওসব এমনিতে শেখা হয়ে যায়। এগুলোর জন্য সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর কী দরকার? এসব আহাজারি দিন দিন বেড়েই চলছে। জানতে ইচ্ছে করে আমাদের অভিভাকরাই কিছু বুঝেন না? 

নাকি শিক্ষাব্যবস্থাই ভুল পথে এগুচ্ছে? জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা আর আইটিতে পারদর্শী করার জন্য কিছু বিষয়ের উপর ব্যবহারিকতো থাকতেই হবে। তা নামেমাত্র না রেখে গুরত্বসহকারে পড়ানো দরকার, কিন্তু একসাথে সকল বিষয়ের পাঠ্যবই পরিবর্তন করে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিপাকে ফেলে দিয়ে কি শিক্ষার উন্নতি সম্ভব? সকল বিষয় নতুন সাজে সাজানো এ যেনো বর ঠিক করার আগেই বিয়ের সাজে সাজানো আর কি। 

সরকারের এক বাঘা মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকও বলেছেন “শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে” অসংখ্য বিশ্লেষক বলেছেন ‘জাতিকে আজ মেধাশূণ্য করার গভীর চক্রান্ত চলছে’ জাতীয় সংসদে জাতীয় পাটির এক এমপি, সরকারের সহযোগী হওয়ার পরও ৭ম শ্রেণির একটি পাঠ্য বই হাতে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেছেন “মাননীয় স্পীকার এ পাঠ্য বইতে লিখা আছে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মকে কটাক্ষ করে অনুচ্ছেদ লিখা হয়েছে” তার বক্তব্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনোযোগসহকারে শুনেন এবং পাঠ্য বইটি ২০২৩ সালেই পাঠ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেয়েও সুবিধা করতে পারেননি। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে এ গুরু দায়িত্ব কে দিয়েছে যে তাকে প্রমাণ করতে হবে মানুষ বানর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে? অথচ ডারউইনের এ বস্তাপচা মতবাদ অনেক আগেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ থিউরী বাজারজাত করার জন্য অনেকে তাকে উন্মাদও বলেছে। অন্য দিকে গ্রেডিং পদ্ধতি নিয়েও রয়েছে ব্যপক সমালোচনা। এ পদ্ধতির পরীক্ষায় বহু নির্বাচনীর ৩০ নম্বর। কথা ছিলো এ ৩০ নম্বর পেতে হলে পুরো বই পড়তে হবে। বাস্তবে বই আর শিক্ষার্থীরা পড়ে না, সব পরিশ্রম করতে হয় প্রকাশককে। তারা কঠোর পরিশ্রম করে গাইড তৈরি করে দেয় আর শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী ৩০ নম্বরের মধ্যে ১০ আর লিখিত ৭০ নম্বরে ২৩ পেলেই পাস। অতএব পাস করা খুবই সজহ। তাই অভিবাবকগণ এখন ফলাফল বলতে বুঝে জিপিএ ফাইভ, এছাড়া অন্য রেজাল্ট যেনো কোনো রেজাল্টই নয়। একজন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে বি-গ্রেড, এর চেয়ে বেশি পাওয়ার কথা নয় অথচ তার বাবা স্কুলে এসে শিক্ষককে ধমকাচ্ছে তার ছেলে কেনো জিপিএ ফাইভ পেলো না! 

অভিভাবক একজন কাচা তরকারি বিক্রেতা সে বুঝেই না জিপিএ ফাইভ অর্থ কি? শিক্ষিত অভিভাবকগণও এ রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। রাজধানীর অভিজাত এলাকার একটি নামিদামি কলেজের এক ছাত্র এইচএসসি পরীক্ষার পূর্বে বাবা মায়ের পক্ষ থেকে এতোটাই  প্রেসারে ছিলো যে, তারা বলতো জিপিএ ফাইভ না পেলে বাড়িতেই উঠতে দিবে না। ছেলেটি ঠিকই আর বাড়িতে উঠেনি ফলাফল প্রকাশ হলে যখন দেখলো সে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে মনের যন্ত্রণা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি একটি ছোট্ট কাগজে লিখেছে “বাবা এবং মা আমি তোমাদেরকে একটি জিপিএ ফাইভ দিয়ে গেলাম” এরপর সে গলায় রশি দিয়ে পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছে। জিপিএ ফাইভ নামের এ সোনার হরিণ কতো জীবন যে নষ্ট করেছে ভবিষ্যতেও করবে তার হিসেব কে রাখবে? পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার উছিলায় শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও লেখা পড়া করতো। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মমতাময়ী মায়ের ভূমিকায় থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি কোমলমতি শিশুদেরকে মানুষিক চাপের মধ্যে রাখতে চান না তাই এসব তুলে দিয়েছেন। 

এখন শিশুরা অনেক সুখে আছে পড়ার চাপ নেই তাই টার্চস মোবাইলটা নিয়ে হিজল গাছের ছায়ায় সারাদিন কি যেনো দেখে? দেখতে দেখেতে হাফিয়ে গেলে দুটি টান মেরে নেয়। শিক্ষকগণ দেখেও না দেখার অভিনয় করেন কারণ শাসন করলে অভিভাকের চাপ সইবে কে? চলছে চলুক, নিজের খেয়ে অন্যের কাক তারানোর দরকার কি? পড়া নেই পরীক্ষা নেই কোচিং নেই চাপও নেই, কেবল মজাই মজা। ছোট সময় প্রবাদ শুনতামÑছাত্র জীবন সুখের জীবন যদি না থাকতো এক্সামিনেশন। এখন আর এক্সামিনেশনের ভয় নেই আর কে ঠেকায়?

প্রাইভেট স্কুলগুলো ৩০০-৪০০ টাকা বেতন আর ৫০০-১০০০ টাকা ভর্তি ফি নিয়ে এসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা না দিলে প্রাইভেট স্কুলের ৫০০ জনসহ মোট ৫৬০ জন শিক্ষার্থী কখনই একটি স্কুলে পড়তে পারতো না। ফলে তারা আর শিক্ষার আলো দেখতে পারতো না। দেশের জন্য তারা বোঝা হয়েই থাকতো। বিশ্লেষকগণ এসব কথা না বলে কেবল প্রাইভেট স্কুলগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠে রমরমা বাণিজ্য করছে তাই বলে যাচ্ছেন। বিগত করোনা মহামারিতে বন্ধ হয়ে গেছে হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যারা ভাড়া করা জায়গায় স্কুল চালাতো। নিজেদের জায়গায় যারা প্রতিষ্ঠান করেছেন তারা অর্ধমৃত অবস্থায় বেঁচে আছে। 

শিক্ষকদের বেতন দিতে না পারায় শিক্ষকগণ রুগ্ন দেহ নিয়ে বেঁচে আছে। কোনো এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেতন না পাওয়াতে সংসার চালানোর জন্য রিক্সাভ্যানে করে কাঁচা তরকারি বিক্রি করেছেন তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে ভাইরালও হয়েছে। বিশ্লেষকদের চোখে এগুলো ধরা পড়ে না কারণ তারা চোখে বিদেশী উন্নত মানের লেন্স লাগিয়েছেন। সরকারি বই দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চালালে সরকারের রাষ্ট্রে বসবাস করলে পরীক্ষা আর সনদ নিতে হলে অবশ্যই সরকার প্রণীত নীতিমালা মেনে চলতে হবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এতো শর্ত কেনো? 

এটাকে সহজ করলে কার পাকা ধানে মই পড়ে? এটা যতো সহজ করা হবে দেশে ততই শিক্ষার হার বাড়বে। শিক্ষকদেরকে কেনো রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে রক্ত ঝরাতে হবে? মদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে সেখানে কি বলা হয়েছে বিক্রেতার যেমন লাইসেন্স নিতে হবে আবার মদ পানকারীকেও লাইসেনস নিতে হবে? যদি বলা হয়ে থাকে তবে মদ পান করে রাস্তার সুন্দরী নারীদের উত্তক্ত করে কিভাবে বলে মাথা ঠিক ছিলো না? অথচ বন্দুক বিক্রেতার যেমন লাইসেন্স লাগে আবার ক্রেতারও তা লাগে। আমাদের ভাগ্য খারাপ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয় প্রকৌশলী আর শিক্ষামন্ত্রী ডাক্তার। দেশে কতোজন কতো রকম অবৈধ ব্যবসা করে, কর ফাকি দেয়, মজুদদারী করে, বিদেশে টাকা পাচার করে, রপ্তানীমুখী পণ্যে ভেজাল দিয়ে দেশের বদনাম করে,ব্যাংক লুট করে, শেয়ার বাজার উজার করাসহ কতো কিইনা করে সে দিকে খেয়াল নেই অথচ অনার্স মাস্টার্স পাস করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়ার জন্য বাবার বিটে বাড়ি বিক্রি করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে গোফ দাড়ি পেকে জাওয়া যুবকরা একটা বিবাহ করবে ৩০ বছরের আইবুড়ি একটু বিয়ের পিঁড়িতে বসবে বাবার বড় মোয়ে শিক্ষকতা করে আর টিউশনির টাকা দিয়ে ছোট ভাই বোনের লেখাপড়া আর বাবা ময়ের ওষুধ কিনবে এতে এতো জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন কেনো? 

নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকা আর চকবাজারের মুর্খ ব্যবসায়ী যখন আইন প্রণেতা হয় তখন এমনটি হবে তাও আমরা বুঝি কিন্তু দেশে কি একেবারই বিবেকবান লোক নেই? প্রাথমিক শিক্ষা অধিতপ্তরের সম্মানিত মহা পরিচালক জনাব শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন “সারা দেশে যথেষ্ট পরিমান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ পর্যাপ্ত শিক্ষক রয়েছে এরি মধ্যে ৩৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আরো শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে” স্যারের কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চাই আমি যে তথ্যটি উপরে দিয়েছি আমাদের ওয়ার্ডে ২৩ টি প্রাইভেট স্কুল সেখানে যে পরিমান শিক্ষার্থী রয়েছে তার জন্য কি এ ওয়ার্ডে আরো ৫-৬ টি সরকারী প্রাথমিক স্কুল করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তাহলে যারা নিজের খেয়ে সরকারের কামলা দেয় বা সরকারের শিক্ষাকার্যক্রম অগ্রগতিতে অসামান্য ভুমিকা রাখছে তাদের টুটি চেপে ধরার দরকার হলো কেনো? 

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের মহাসচিব জনাব মিজানুর রহমানসহ অন্যান্য নেতারা জানিয়েছেন “যেসব শর্তারোপ করা হয়েছে তাতে বন্ধ হয়ে যাবে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন” যেখানে করোনা মহামারীর পর প্রাইভেট স্কুলগুলোর মালিকগন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দিশেহারা, তাদেরকে একটু অক্সিজেন দিয়ে বাচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবে তা না করে অক্সিজেন সিলেন্ডার খুলে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

 

https://www.dailysangram.info/post/542610