৬ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৯:৩৫

১০ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে

চলতি অর্থবছরের মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বৈদেশিক অর্থায়নের (ঋণ/অনুদান) অংশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি কাটছাঁট হতে পারে, যা কমিয়ে দিতে পারে প্রকল্পের গতি। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈশ্বিক সংকটে এডিপিতে কমতে পারে বৈদেশিক অর্থায়ন। এর জেরে হতে পারে এই অর্থ কাটছাঁট।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়ন এক লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক উৎস থেকে পাওয়া যাবে বাকি ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা করপোরেশনের ১১ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, বরাবরের মতো এবারের সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক অর্থায়ন কাটছাঁট করা হলে এবার এর প্রভাব প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি পড়বে। কারণ সরকারের হাতে টাকা নেই। সরকার নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে কম যাবে। যেসব প্রকল্প চলমান, সেগুলোর বাস্তবায়ন আগে হবে।

এর মধ্যে বৈদেশিক অংশের বরাদ্দ কাটছাঁটের প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। এ মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত বৈদেশিক অর্থায়নের তালিকা প্রণয়ন করবে ইআরডি।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে জরুরি ভিত্তিতে তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তারা তাদের তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে।

নতুন সচিবের নেতৃত্বে বৈঠক করে শিগগির আমরা চূড়ান্ত হিসাব ঠিক করব। এর মধ্যে একটা খসড়া হিসাব করেছি। চূড়ান্ত তালিকা শেষে সংশোধিত এডিপির জন্য তথ্য পাঠানো হবে পরিকল্পনা কমিশনে।’

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, চলতি বছরের ২২ অক্টোবর থেকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি এবং ২০২৪-২৫, ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছরের এডিপি প্রাক্কলনের অর্থ নির্ধারণে তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট চলমান এবং নতুন প্রকল্পের জন্য কত বরাদ্দ প্রয়োজন, তার তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টার (জুলাই থেকে অক্টোবর) পর্যন্ত চার মাসের বৈদেশিক সাহায্যের প্রকল্পগুলোর ব্যয় বা বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে সংশোধিত এডিপির জন্য বরাদ্দের প্রাক্কলন করতে হবে। পাশাপাশি আগামী তিনটি অর্থবছরের জন্য এমটিবিএফ (মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো) তৈরির জন্যও তথ্য দিতে হবে।

ইআরডির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে ক্রমাগত বাড়ছে সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপ। এক বছরের ব্যবধানে পরিশোধের পরিমাণ হয়েছে দ্বিগুণ। নতুন অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-আগস্ট) বাংলাদেশ ঋণের বিপরীতে পরিশোধ করেছে ১২ হাজার ৮৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ১১১ টাকা দরে)। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে সরকার পরিশোধ করেছে ছয় হাজার ৯০৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। যতটা না ঋণের আসল পরিশোধ বেড়েছে, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে সুদের পরিমাণ। গত অর্থবছরে যেখানে ঋণের সুদ বাবদ ২০ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল, সেখানে এবার ৫১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। ইআরডির সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

একই সময়ে কমেছে অর্থছাড়ও। চার মাসে মোট বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয়েছে ১৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ২১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। অর্থাত্ বছরের ব্যবধানে ছাড় কমেছে তিন হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে অর্থছাড় কমেছে। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধে আরো বেশি চাপের মুখে পড়তে হবে বলেও মনে করেন তাঁরা।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বৈদেশিক অর্থ ব্যয় কমার চিত্র। এতে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বৈদেশিক অর্থ বরাদ্দ রয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করেছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭.৯৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বৈদেশিক অর্থ খরচের হার ছিল ৮.৫৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ব্যয় কমছে। সেই সঙ্গে সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এখনো খরচের খাতাই খুলতে পারেনি। অর্থাত্ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের তিন মাস পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এক টাকাও ব্যয় করতে পারেনি। পিছিয়ে থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও ভূমি মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া রয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার এখন নানামুখী সংকটে আছে। কারণ সরকারের হাতে এখন কোনো টাকা নেই। এর মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক অর্থায়ন আরো বেশি কাটছাঁট হবে বলে মনে করি। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাঘাত ঘটবে। আর সরকার তো এখন বড় নতুন প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে না। যে প্রকল্পগুলো চলমান, সেগুলো শেষ করাই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/12/06/1342945