৬ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৯:৩৪

ভরা মৌসুমেই পর্যটনে ধস

 

পর্যটনের এখন ভরা মৌসুম চলছে। অথচ টানা অবরোধ হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো একেবারে পর্যটন শূন্য। এতে চরম ধস নেমেছে পর্যটন ব্যবসায়। পর্যটন খাতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীসহ এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ মানুষ। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পটুয়াখালী, সিলেট মৌলবীবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় পর্যটক নেই বললেই চলে। হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট প্রায় ফাঁকা। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের বাম্পার ছাড়েও সাড়া নেই পর্যটকদের। প্রতিদিনই বুকিং বাতিল। বিদেশি পর্যটক প্রায় শূন্য, মিলছে না সিকিউরিটি ছাড়। তাদের রয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১ হাজার ৪০০ পর্যটন স্থান রয়েছে। এর মধ্যে ২৮১টি স্থানে পর্যটকরা নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। প্রতিবছর এসব পর্যটন কেন্দ্রে প্রায় দুই কোটি দেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। কিন্তু চলতি এই মৌসুমে এর অর্ধেকেরও কম পর্যটক উপস্থিতি আশঙ্কা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে পর্যটন ব্যবসায় চরম মন্দা চলছে। বেকার হয়ে পড়ে হাজারো কর্মী। দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে সারাদেশের পর্যটন শিল্পের এ নাজুক অবস্থা কয়েকটি পর্বে তুলে ধরা হচ্ছে। আজ প্রথম পর্বে চট্টগ্রাম এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের অবস্থা তুলে ধরা হল :
পর্যটন-বিনোদন, অবকাশ যাপন তথা গৎবাঁধা যান্ত্রিক জীবন ছেড়ে প্রকৃতির নিসর্গের কাছে গিয়ে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলতে চায় ভ্রমণপিপাসু মানুষ। ‘হাওয়া বদল’। যা সহজাত চাওয়া। কিন্তু এবার পর্যটনের ভরা মৌসুমেই উল্টো চিত্র। চারদিকে প্রায় শূন্যতা। গোটা পর্যটন খাতেই ধস নেমেছে। চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্প-ব্যবসায় খাতের উদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদ ও পর্যটকগণ বলছেন, দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যাপক ধাক্কা লেগেছে সর্বত্র। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সরকারি দল ও বিরোধী দলসমূহের পালটা-পালটি অবস্থানে এক সংঘাতময় অবস্থা, সর্বাত্মক অবরোধ, হরতাল, বিক্ষোভসহ লাগাতার কর্মসূচি চলছে। সেই সঙ্গে বেশ কয়েক মাস যাবৎ অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অস্থিরতা, অশান্তি, অজানা ভয়-ভীতি ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি। এতে করে বড়সড় ধকল এসে পড়েছে পর্যটন খাতে। অথচ পর্যটকের ভিড়ে চট্টগ্রাম এখন সরগরম থাকারই কথা।

পর্যটন-বিনোদনের প্রধান গন্তব্য বৃহত্তর চট্টগ্রামে এ সময়ে পর্যটন-ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যে রঙিন ও জমজমাট দৃশ্য প্রতিবছর চোখে পড়ে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যটনের পিক সিজন ধরা হয়। ভরা মৌসুমেই চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পর্যটন খাত এখন মলিন নির্জীব। চারদিকে গ্রাস করেছে চরম মন্দা। তাছাড়া সামগ্রিক অর্থনৈতিক সঙ্কট ও অনিশ্চয়তার কারণে বিশেষত ভ্রমণপ্রেমী মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাধ-আহ্লাদ পূরণের মতো টাকার সংস্থান নেই। বাজারের আগুনে দিশেহারা মানুষ। কোথাও নেই স্বাভাবিক আর্থিক লেনদেন সার্কুলেশন। পশ্চিমা দেশসমূহ থেকে বাংলাদেশের এই মনোরম মৌসুমে অনেক পর্যটক চট্টগ্রামে আসেন। এবার বিদেশি পর্যটক আগমন প্রায় শূন্য। অধিকাংশ স্কুল-কলেজ, মাদরাসার বার্ষিক পরীক্ষা শেষে অনেকে সপরিবারে ঘুরতে উদগ্রীব। আবহাওয়া-প্রকৃতিও বেড়ানোর অনুকূলে শান্ত স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে বিদ্যমান অস্থিরতার কারণে রুজি-রোজগারের তাগিদ ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষজন তেমন দূরে কোথাও যেতে ঝুঁকি নিতে চাইছে না। পিকনিক গাড়ি নেই বললেই চলে।

বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি অর্থাৎ উত্তর প্রান্তের মীরসরাই-রামগড়-সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা সী-বীচ, ফয়’স লেক, সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে সাজেকভ্যালি, রাঙ্গামাটির শুভলং, লামা-আলীকদম-থানচি, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলজুড়ে সুসমৃদ্ধ প্রকৃতির অকাতরে ঢেলে দেয়া সৌন্দর্য্য-সম্ভার। অথচ চট্টগ্রামের শতাধিক পর্যটন-বিনোদন, অবকাশ যাপনের স্পট এবং এখানকার অভিজাত হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজগুলো এ মুহূর্তে প্রায়ই ফাঁকা। বাম্পার মূল্যছাড়ের ঘোষণা দিয়েও পর্যটকরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের পর বর্তমান পর্যটন মৌসুমে যে হারে পর্যটকের গাড়িবহর চলাচলের আশা করা হয়েছিল তাও নেহায়েৎ কম। সমুদ্রবিহারে পর্যটন মৌসুমে বিলাসবহুল জাহাজ, নৌযানবহর অলস বসে আছে। তারকা মানের হোটেল-রিসোর্ট মালিক থেকে শুরু করে পর্যটক-নির্ভর হকার সবার মাথায় হাত। আয়-রোজগারে স্বস্তিতে নেই কেউই।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সবার মাঝে উদ্বেগ। ঝুঁকি নিতে চান না কেউ। হোটেল-রিসোর্টের বুকিং বাতিল হচ্ছে। বিয়ে-শাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানাদি পিছিয়ে যাচ্ছে কিংবা বাদ যাচ্ছে। পর্যটনস্পট ছাড়াও কমিউনিটি সেন্টারগুলো শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহজুড়ে ফাঁকা। পর্যটনকেন্দ্রিক চট্টগ্রামে যেসব হস্ত ও কুটির শিল্পপণ্য মেলা, প্রদর্শনী প্রতিবছর হয়ে থাকে তাও নেই। অন্যদিকে মনমতো বেড়ানোর জন্য সিকিউরিটি ছাড় মিলছে না বিদেশি নাগরিকদের। বর্তমান অবস্থায় বিদেশি পর্যটকরা এমনিতেই ভয়-শঙ্কায়। সড়ক, নৌ, রেলপথের পাশাপাশি আকাশপথে দেশি-বিদেশি পর্যটকের চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া ক্রমাগত কমছে। ট্যুর অপারেটররা অলস বসে আছে।

পর্যটন-বিনোদন নির্ভর শত শত মৌসুমী ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দায় আক্রান্ত। বসিয়ে রেখে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ, বিদ্যুৎ-গ্যাস, পানির বিলসহ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন খরচ মেটাতে গিয়েই পর্যটন শিল্প-বাণিজ্য খাতের মালিকদের হিমশিম দশা। টানতে হচ্ছে ব্যাংকঋণের বোঝা। বেকার বা অর্ধ-বেকার হয়ে পড়ছে হাজারো কর্মী। পর্যটন মৌসুমে যারা হরেক রকম কাজকর্ম করে সংসার চালায় তাদের দুঃখ-দুর্দশা চরমে। সবমিলিয়ে চট্টগ্রামেই পর্যটন শিল্প-ব্যবসায় খাতে প্রতিদিন শত কোটি টাকা লোকসান যাচ্ছে। ভরা মৌসুমজুড়ে পর্যটনে খরা কাটবে এমনটি আলামত নেই।

বর্তমান পরিস্থিতিতে পর্যটন খাতের নাজুকদশা প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান সময়টা বিশেষত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে পর্যটন বিনোদনের জন্য ভরা মৌসুম। পর্যটন চাঙ্গা থাকার সবচেয়ে উপযোগী এ সময়ে এবং সামাজিক ও কর্পোরেট ইভেন্ট, অনুষ্ঠানাদির ভর মৌসুমে বিপর্যয় নেমে এসেছে। পর্যটন খাত পর্যুদস্ত। পরিস্থিতির আপাতত উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। এভাবে অস্থিতিশীল অবস্থা চলতে থাকলে পর্যটন সেক্টরে আরো ধস নামবে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এলাকা প্রায় পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রামে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ ফয়’স লেক কনকর্ড অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডের ম্যানেজার (মার্কেটিং) বিশ^জিৎ ঘোষ ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে পর্যটক ও অতিথিরা গাড়িতে আসা-যাওয়ায় ঝুঁকি মনে করছে। ইপিজেডসমূহ, বিভিন্ন শিল্প-বাণিজ্য, রফতানিকারক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিনোদন, অনুষ্ঠান-ইভেন্ট আয়োজনের ভরা মৌসুম এখন। কর্পোরেট অতিথি এবং গ্রুপ ট্যুর ও সপরিবারে পর্যটক অতিথিরা ভালো আবহাওয়ায় এ সময়েই বেশিহারে আসেন। কিন্তু অস্থিরতার কারণে অনেক বুকিং বাতিল হচ্ছে। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়েই ফাঁকা যাচ্ছে। ডিসকাউন্ট ও অন্যান্য অফার ঘোষণা দিয়েও তেমন সাড়া মিলছে না। আমরা নতুন ও আধুনিক কিছু বিনোদন সুবিধা এবার সংযোজন করেছি। অথচ সার্বিকভাবে আমাদের বিনোদন-পর্যটন সুবিধাসমূহের বিপরীতে প্রায় ৮০ শতাংশই ফাঁকা থাকছে। বিদেশিরা খুব কমই আসছেন। এ অবস্থায় ব্যবসা বিপর্যস্ত। স্টাফদের বেতন-মজুরি, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন খরচ মেটাতে গিয়ে ব্যাপক লোকসান গুণতে হচ্ছে।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী তারকা হোটেল, হোটেল আগ্রাবাদের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার হাসানুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পর্যটন ও হোটেল খাতে। ইউরোপীয় দেশসমূহের পর্যটকরা খুব কমই আসছেন। তাদের পছন্দমতো ঘুরে বেড়ানোর জন্য সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছেন না। সামগ্রিকভাবে রাজস্ব আয় কমছে। অথচ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। গত নভেম্বর মাসের তুলনায় চলতি ডিসেম্বর মাসে পর্যটক গেস্ট আগমন আরো হ্রাসের দিকে। ব্যবসায় মন্দা অবস্থা।

প্রকল্পভিত্তিক বিদেশি গেস্ট আছেন। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যটক তেমন নেই। বিয়ে-শাদিসহ পর্যটনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের ইভেন্ট, প্রদর্শনীর ভরা মৌসুম এখন। কিন্তু অনেক বুকিং স্থগিত কিংবা বাতিল হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে বুকিং পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে।

পার্বত্য রাঙ্গামাটির প্রবীণ সাংবাদিক সমাজসেবক দৈনিক গিরিদর্পন পত্রিকার সম্পাদক এ কে এম মকছুদ আহমেদ জানান, পাহাড়ের পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো রয়েছে। তবে দেশে অস্থিরতার প্রভাবে রাঙ্গামাটিসহ প্রায় সর্বত্র পর্যটক আগমনের হার অনেকটাই কমে গেছে। পর্যটন-নির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা বিরাজ করছে।

‘প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রামে ঘুরতে গেলেই অভিভক্ত বাংলা দর্শন হয়ে যায়’। একথা প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত। প্রতিবছর লাখো মানুষ ছুটে আসে চাটগাঁর মায়াবী প্রকৃতির কোলে। অথচ দেশের সার্বিক অস্থিতিশীলতার বিরূপ প্রভাবে পর্যটন আটকে গেছে নজিরবিহীন সঙ্কটে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের শতাধিক পর্যটন বিনোদন কেন্দ্র এখন খাঁ খাঁ করছে। প্রমোদ ভ্রমণ বিনোদনে কোথাও নেই ভিড় ছোটাছুটি ব্যস্ততা। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে থমকে গেছে পর্যটকের কোলাহল। যা আগে কখনোই দেখেনি কেউ।

টানা অবরোধ হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভর পর্যটন মৌসুমে লাঠে উঠেছে কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসা। পর্যটন খাতে দেখা দিয়েছে মহামন্দা। সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ডাকা হরতাল ও অবরোধে পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। ব্যবসায়ীদের প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকার গচ্ছা। এতে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীসহ এ খাতের সঙ্গে জড়িতরা হাজার হাজার মানুষ।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে এখন ভর পর্যটন মৌসুম। গেলো নভেম্বর মাসে অবরোধ হরতালে কক্সবাজারের পর্যটন খাতে কয়েক›শ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ডিসেম্বরেও চলছে বিরোধী দলের কর্মসূচী। আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা কমার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। বরং অস্থিরতা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এহিসেবে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পুরো পর্যটন মৌসুমটাই চলে যাবে রাজনৈতিক অস্থিরতায়।

গতকাল সরেজমিন সৈকতের লাবনী পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, পর্যটক শূন্য কক্সবাজার সৈকত। চারদিকে নীরবতা। ব্যস্ততা নেই সৈকতের ফটোগ্রাফার, বিচ বাইক-ওয়াটার বাইক চালক ও ঘোড়াওয়ালাদের। একই সঙ্গে বালিয়াড়িতে খালি পড়ে আছে কিটকটগুলো। একইভাবে খালি পড়ে আছে পাঁচ শতাধিক হোটেল মোটেল।

এদিকে বিমানে কিছু পর্যটক আসছেন। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। এছাড়াও সম্প্রতি কক্সবাজার-ঢাকা ট্রেন চালু হওয়ার পর হাজার খানেক পর্যটক আসছেন কক্সবাজারে। কিন্তু ৫শতাধিক হোটেল মোটেল ও সম পরিমান রেষ্টুরেণ্টের ৫ভাগ ব্যবসাও এতে হচ্ছেনা।
এমনিতেই কক্সবাজারে পর্যটক নেই। তার উপর বেড়াতে আসা এক সৌদি পর্যটককে ৩ডিসেম্বর ছিনতাইকারীরা ছুরি মেরে সব কেড়ে নিয়েছে। তবে এর সাথে জড়িত ৪ জনকে পাকড়াও করেছে পুলিশ।

অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয় পর্যটন মৌসুম। চলে মার্চ মাস পর্যন্ত। নভেম্বর-ডিসেম্বরে লাখো পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত থাকে সাগর সৈকত। কিন্তু পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই বিরোধীদলের ডাকা সমাবেশ, হরতাল ও অবরোধের কারণে পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে কক্সবাজার সৈকত। এতে বিপাকে পড়েছে সৈকতপাড়ের হোটেল-মোটেল ফটোগ্রাফার, বিচ বাইক, ওয়াটার বাইক, ঘোড়াওয়ালা ও কিটকট ব্যবসায়ীরা। সৈকতপাড়ের ফটোগ্রাফার ইব্রাহীম বলেন, এবার পর্যটন মৌসুমে ভাল ব্যবসা হবে আশা করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখি ভর মৌসুমেও পর্যটক শূন্য। গেলো ১৫ দিন সৈকতে আসছি আর যাচ্ছি কোন আয় হচ্ছে না। কারণ হরতাল ও অবরোধের কারণে সৈকত এখন পর্যটক শূন্য। বিচ চালক রহিম উল্লাহ বলেন, ঘূর্ণিঝড় হামুন, বিএনপি-জামায়াতের সমাবেশ, হরতাল ও অবরোধের কারণে গেলো এক মাস ধরে পর্যটক শূন্য কক্সবাজার সৈকত। যার কারণে বিচ বাইক নিয়ে সৈকতে এসে বসে আছি। পর্যটক না থাকায় ব্যবসা হচ্ছে না।

কিটকট ব্যবসায়ী আব্দু সবুর বলেন, বালিয়াড়িতে ২০ টি চেয়ার রয়েছে। গত ২০ দিনে ধরে ২০০ টাকার বেশি আয় করতে পারেনি। হরতাল-অবরোধে আমাদেরকে একদম শেষ করে দিয়েছে। সৈকতপাড়ে রয়েছে সহস্রাধিক শুঁটকি ও বার্মিজ পণ্যের দোকান। পর্যটক শূন্যতার কারণে ব্যস্ততা নেই এসব দোকানেও। তারা বলেছেন, পর্যটন মৌসুমে শুরুতেই লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। গোটা মৌসুমই হয়ত এভাবে যাবে। সৈকতের লাবনী পয়েন্টের ছাতা মার্কেটের আচার ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, গেলো ২০ আগেও প্রতিদিনই ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার আচার পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেছি। কিন্তু এখন পর্যটক নেই বেচাবিক্রিও নেই। দোকান খুলে বসে আছি, সকাল থেকে এক টাকারও আচার বিক্রি করতে পারেনি।

ছাতা মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন দুলাল বলেন, ছাতা মার্কেটে ২০০ মতো দোকান রয়েছে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বার্মিজ পণ্য বেচাবিক্রি হতো। কিন্তু এখন বেচাবিক্রি একদম নেই বললেই চলে। বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল ও অবরোধে পর্যটক না থাকায় ব্যবসা হচ্ছে না। প্রতিদিনই ৩ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে।

পর্যটনের সুবাদে কক্সবাজারে রয়েছে ৫ শতাধিক হোটেল মোটেল রিসোর্ট গেস্ট হাউস ও কটেজ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে পর্যটক না থাকায় নেমে এসেছে নীরবতা। হরতাল ও অবরোধে কক্সবাজারের পর্যটনখাতে প্রতিদিনই শতকোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।

হোটেল কক্স-টুডে’র ব্যবস্থাপক আবু তালেব শাহ বলেন, ভরা মৌসুমে পর্যটক না থাকাটা হতাশার বিষয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘ হলে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। মূলত কক্সবাজার পর্যটননির্ভর জেলা। এখানকার অনেকেই পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করব তারা যাতে পর্যটন খাতকে রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখেন।

কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল ও অবরোধের কারণে কক্সবাজারের পর্যটনখাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় কক্সবাজার এখন পর্যটক শূন্য। যার ফলে কক্সবাজারের পর্যটনের সবখাতে প্রতিদিনই ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে। হরতাল ও অবরোধ এভাবে অব্যাহত থাকলে ব্যবসায়ীরা একদম শেষ হয়ে যাবে।

https://dailyinqilab.com/national/article/621915