৫ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:২৬

দেশ কি দল বিশেষের জমিদারী মুক্ত হবে না?

ড. মো. নূরুল আমিন

 

পাঠকদের অনেকেই আমার কাছে বিদ্যমান রাজনীতির হালচাল সম্পর্কে জানতে চান। আমি বিব্রত বোধ করি। আমি রাজনীতিক নই; তবে রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করি। মাঝে মধ্যে আমি বুঝতে পারি না, দেশে কি রাজনীতি আছে? মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার পুনরুদ্ধার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি নির্বাচনের দাবিতে বিরোধীদলগুলো আন্দোলন করছে। সরকার রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে কঠোর হস্তে এই আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয়, তারা একতরফা নির্বাচনের লক্ষ্যে সিডিউল ঘোষণা করে মনোনয়নপত্র নেয়ার কাজও সম্পন্ন করছেন। এটা করতে গিয়ে গরু কেনা বেচার ন্যায় রাজনীতির হাটে চড়া দামে রাজনীতিক কেনা বেচাও শুরু করেছেন। এছাড়াও সুন্দরী নারী সরবরাহের কাজও চলছে বলে বাজারে গুজব রয়েছে। কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেছেন যে, সরকার ও সরকারি দল জেনা ব্যভিচারকে যেমন উৎসাহিত করছেন (ইডেন ও আনন্দমোহন কলেজ ছাত্রীদের সংবাদ সম্মেলন এবং লালবাগের আওয়ামী লীগ নেত্রীর লাইভে এসে যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তব্য প্রদান) তেমনি রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রেও অনৈতিকতার (Intellectual and Political Prostitution) প্রসার ঘটাচ্ছেন। এই অবস্থায় দেশে রাজনীতি থাকতে পারে না। এটা দুর্জন রাজনীতিকদের ভ্রষ্টাচারের লীলাভূমিতে পরিণত হয়।

১৯৬২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি পশ্চিম জার্মানী সফরে গিয়ে বার্লিন প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে এক জনসভায় বলেছিলেন, গণতন্ত্রের অনেক দোষ ত্রুটি আছে সত্যি, কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশসমূহে মানুষকে আটকে রাখার জন্য দেয়াল নির্মাণ করার প্রয়োজন হয় না। বলাবাহুল্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীকে ভাগ করে রাশিয়া তার পূর্বাংশ (East Germany) দখল করে নিয়েছিল এবং সেখানে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাদের এই কমিউনিস্ট স্বর্গরাজ্য থেকে যাতে মানুষ পালিয়ে আসতে না পারে সে জন্য পূর্ব জার্মানীকে আলাদা করে মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল যার নাম দেয়া হয়েছিল Berlin Wall। অর্ধ শতাব্দি তা টিকেনি। কম্যুনিজমের পতনের পর জার্মানরা এই ওয়াল ভেঙে পুনরায় দ্বিখ-িত জার্মানীকে একীভূত করেছিল। রুশ আর চীনারা ভেঙেছিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাদের মূর্তি এবং স্মৃতিসৌধগুলো।

আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়েছি ও লড়ছি। গণতন্ত্র নামের অদৃশ্য বস্তুটি বিচিত্র রূপিনী, রাশিয়া যখন তার আশপাশের দেশগুলে জবরদখল করে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে গিয়েছিল তখন সেই সাম্রাজ্য চিরদিন কব্জায় রাখার জন্য নাম দিয়েছিল Soviet Socialist Republic of Russia। সাথে সাথে তাদের দখলকৃত রাষ্ট্রগুলোতে ব্যাপক হারে রুশ বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা নিয়েছিল। ধর্ম নিষিদ্ধ করে মুসলমানদের মসজিদ মাদরাসা মক্তব প্রভৃতি শুধু তারা ধ্বংসই করেনি, অনেক মসজিদ মাদরাসাকে ঘোড়ার আস্তাবলও বানিয়েছিল, হাজার হাজার আলেম ওলেমাদের হত্যাও করেছিল। এই অপকর্মগুলো তারা করেছিল যাতে করে দেশগুলো কোন দিনই কম্যুনিস্ট রাশিয়ার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে না পারে। চেয়ারম্যান মাও সেতুং গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইশেককে তাড়িয়ে চীনকে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না নাম দিলেন। সাথে সাথে তিনি বিপ্লবের নামে গণহত্যাও শুরু করে দিলেন। চীনেও ধর্ম নিষিদ্ধ হলো, মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহীত হলেন। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তারা রাতারাতি নাম পরিবর্তনে বাধ্য হলেন। তাদের মসজিদ, মাদরাসা-মক্তব বন্ধ করে আস্তাবল আর গুদাম ঘরে রূপান্তরিত করা হলো। চীনা মর্দে মুজাহিদরা দমে গেলেন না, মাটির নিচে ঘর করে মসজিদ মাদরাসা ও কুরআন শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করে গোপনে দ্বীনী কাজ চালিয়ে গেলেন। বেইজিং নগরীর কূটনৈতিক এলাকা সন্নিহিত ইসলামী কমপ্লেক্সের পাশে তাদের এই কীর্তির কিছু নমুনা আমার স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক নাম দেয়া হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বা Peoples Republic of Bangladesh. তখন প্রশ্ন উঠেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রজা কোথায়? বৃটিশরা এই দেশ দখল করে সবাইকে প্রজা আখ্যা দিয়েছিল। তারা চলে যাবার পর ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলো; তারা তো কেউ প্রজাতন্ত্র হলো না, তাদের নাগরিকদের প্রজা বানালো না। ভারত শাসনতান্ত্রিকভাবে তার নাম রাখলো Republic of India  বা ভারতীয় সাধারণতন্ত্র। পক্ষান্তরে পাকিস্তান হলো Islamic Republic বা ইসলামী সাধারণতন্ত্র। অথচ বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের পিপলস শব্দটি যোগ হয়েছে। Peoples- এর বাংলা অনুবাদ কি প্রজা? আওয়ামী লীগ নেতাদের বিদ্যার বহর দেখে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। তারা কি পড়ালেখা করে নিজে পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট নিয়েছেন, না প্রক্সি পাঠিয়ে তা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। একটা স্বাধীন দেশের Peoples বলতে অবশ্যই প্রজা বুঝায় না। তারা স্বাধীন নাগরিক, অধিবাসী, ইতরলোক বা প্রজার তরজমা এখানে প্রযোজ্য হয় না। পাকিস্তানের পঁচিশ বছর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা প্রজা ছিলেন না। স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র নাম ধারণ করলো। যেখানে প্রজা আছে, সেখানে রাজা, রানী বা জমিদার তালুকদার থাকেন। যেমন বৃটেন, বেলজিয়াম, সুইডেন, মালয়েশিয়া, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্র, রাজতান্ত্রিক দেশ, সৌদি আরব, আমিরাত প্রভৃতিও তাই। নেপাল ছিল এখন নেই। কিন্তু ভুটানের রাজা আছে, সে দেশের অধিবাসীরা তার প্রজা। আমি যে দেশগুলোর কথা উল্লেখ করলাম সেগুলোর সর্বাধিনায়ক হচ্ছেন রাজা বা রানী। তবে বেশিরভাগ রাজা রানীর হাতে বিশেষ কোনো ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের সর্বাধিপতি হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট। আবার সরকার প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী যিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের অধিবাসীরা কেউই তার প্রজা নন, যদিও আওয়ামী লীগ নামক দলটি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকেই নিজেদের রাজা রানী বা জমিদারের ভূমিকায় নামিয়ে সাধারণ দেশবাসীকে প্রজা গণ্য করে আসছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার যে, ১৭৯৩ সালে বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড কর্নওয়ালিস জমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা ও খাজনা পরিশোধের ক্ষেত্রে সূর্যাস্ত আইন জারি করায় হিন্দু মুৎসদ্দি ও জোতদারদের হাতে জমিদারির প্রথা ৯৮% চলে যায়। অবশিষ্ট দুই শতাংশ থাকে মুসলমানদের হাতে। হিন্দু জমিদারদের মধ্যে অনেকে পশ্চিম বাংলার বাসিন্দা হিসেবে পূর্ব বাংলার জমিদারী করেছেন, যেমন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পূর্ব বাংলার দুটি জেলায় তার জমিদারী কাচারী ছিল। হিন্দু জমিদারদের মধ্যে প্রজাবৎসল লোকের সংখ্যা খুবই কম ছিল। এদের বেশিরভাগই প্রজা উৎপীড়ক ছিলেন, প্রজাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতেন না। মুসলমান প্রজারা তাদের বাড়ি বা কাচারীর সামনে দিয়ে জুতা পায়ে, পাল্কিতে চড়ে, সাইকেলে চড়ে এবং ছাতা মাথায় যাতায়াত করতে পারতেন না। এমন অনেক নজির আছে, তাদের অত্যাচারের হাজার হাজার দৃষ্টান্ত রয়েছে। শুধু প্রজাদের প্রতি নয়, মুসলিম জমিদারদের প্রতিও তাদের আচরণ ছিল অপমানকর। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর পরিবারের জমিদারী ছিল। তার বড় ভাই যুগভেরী সম্পাদক আমিনুর রশীদ চৌধুরীর মুখে আমি একটি ঘটনা শুনেছিলাম। তাদের জমিদারীর পাশেই ছিল আরেক হিন্দু জমিদারের বাড়ি। তার বক্তব্য অনুযায়ী রশীদ পরিবার সব সময়ই হিন্দু জমিদার পরিবারের সাথে সদ্ভাব ও সৌজন্যমূলক আচরণ বজায় রাখতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কখনো ইতিবাচক সাড়া পেতেন না। মুসলমানদের তারা ঘৃণা করতেন। একবার তারই এক বড় ভাই আইসিএস পাস করে অবিভক্ত ভারত সরকারের একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপত্র পেলেন। শিষ্টাচারের অংশ হিসেবে তারা ভাবলেন ছেলেটি প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে সুখবরটি দিয়ে তাদের দোয়া-আশীর্বাদ নেয়া দরকার। প্রতিবেশী হিন্দু জমিদার বাবুকে তারা কাকা ডাকতেন। যেমন চিন্তা তেমনি কাজ হলো। চৌধুরী পরিবারের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ছেলেটি কাকা বাবুকে সালাম দেয়ার জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিলেন। কাকা বাবু খবরটি আগেই শুনেছিলেন। ছেলেটি যখন তার বাড়ি গেলেন তখন তিনি বৈঠকখানায় ছিলেন। মনে হলো আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বসে ছিলেন একটি কুশন চেয়ারে। তার পাশে একটি বেতের মোড়া এবং কক্ষের কোণায় একটি চেয়ার রাখা। পেয়াদা হুকুমের অপেক্ষায় বাবুর পিছনে দাঁড়িয়ে। কাকা বাবু বিপদে পড়েছিলেন, কোথায় বসতে দিবেন। হোকনা জমিদারের ছেলে, মুসলান নেড়ে তো। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে গেছে, তাই দূরে চেয়ারও রাখলেন। আবার তুমি বলবেন না আপনি বলবেন তা নিয়েও দোটানায়। যাই হোক, রশিদ পরিবারের ছেলেটি ঘরে ঢুকেই তাকে নমস্কার করে পেয়াদাকে দিয়ে চেয়ারটা সামনে আনিয়ে অনুমতির অপেক্ষা না করেই বসে পড়লেন। কাকা বাবুর তখন দম বন্ধ হবার উপক্রম। আপনি-তুমির ঝামেলায় না গিয়ে থার্ড পার্সনে কথা বলা শুরু করলেন। এদের রাজত্বেই পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মুসলমানের প্রজা হয়ে থাকতে হয়েছে। ঢাকার নবাব পরিবার ও কুমিল্লার পশ্চিমগাঁও-এর নবাবরাও জমিদার ছিলেন। মুসলিম এই জমিদার তাদের জনহিতকর কাজের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ হিন্দু জমিদাররা এর বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার East bangal Estate Acqusition and tenancy ACT শীর্ষক আইন পাস করে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ এবং প্রজাস্বত্ব আইন চালু করেন। ফলে কেউ আর জমিদার থাকলেন না সবাই সমান হয়ে  গেলেন। কিন্তু জমিদাররা জমিদারী হারিয়ে বিপদে পড়লেন। সরকার তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সত্য কিন্তু প্রজাদের সাথে কোলাকুলি করে তারা কিভাবে বসবাস করবেন? তাই হিন্দু জমিদারদের প্রায় সকলেই তাদের রাজপ্রাসাদ, জলসাঘর, জমিজমা সব ছেড়ে কোলকাতা ও অন্যান শহরে চলে গেলেন। ভাগ্যের পরিহাস এসব জমিদারের নিগৃহীত প্রজাদের সন্তানেরা স্বাধীন বাংলাদেশে এই জমিদার বাড়িগুলোকে আর্কিয়োলজিকেল ডিপার্টমেন্টের অধীনে এনে সংস্কার-সংরক্ষণের দাবি তুলে থাকেন। দেশে জমিদার থাকুক বা না থাকুক আওয়ামী লীগ কিন্তু তাদের নিজেদের জমিদার বলেই মনে করে এবং দেশের মানুষ তাদের দৃষ্টিতে প্রজা।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা এমন এক দেশে জন্মগ্রহণ করেছি যেখানে গণতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতেই জীবন শেষ। অবস্থা এমন যে আমাদের নাতিরা শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের মুখ দেখতে পাবে কিনা তা হলফ করে বলা যায় না। সেই ছোট বেলাতেই গণতন্ত্রের গাড়িতে সওয়ার হয়েছিলাম। এই গাড়ি কখনো আগায় আবার কখনো পিছায়, এভাবে চলছে তো চলছেই; কবে যে তার গন্তব্যে পৌঁছবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই জানেন। আমাদের আয়ু তো সীমিত, এর মধ্যে কেউ যদি ধৈর্যহারা হয়ে এর চাইতে বৃটিশ বা পাকিস্তান আমলই ভাল ছিল বলে মন্তব্য করেন তাহলে কি তাকে দোষ  দেয়া যায়? আবার আওয়ামী জমিদারীর অধীনে গণতন্ত্র আশা করা কি বাস্তব?

https://www.dailysangram.info/post/542397