৮ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:২৯

আবাসন খাত এখন আইসিইউতে

* অর্থ বরাদ্দ ও ফি কমানোর দাবি
নানা সংকটে দেশের আবাসন খাত এখন আইসিইউতে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। প্লট বা ফ্ল্যাটের মাত্রারিক্ত রেজিস্ট্রেশন ফি, ব্যাংকের অতিরিক্ত সুদ এই খাতকে এখন কোমায় নিয়ে যাচ্ছে। ফলে টাকা আছে এমন উদ্যোগী ও আগ্রহী ব্যক্তিরাও এখন বিদেশে টাকা পাচার করছে অথবা বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছে। দেশের আবাসন খাতের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখার পাশাপাশি বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্যোগেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।
গতকাল রোববার ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত জাতীয় অর্থনীতিতে আবাসন খাত শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেন্টার ফর কমিউনেকশন নেটওয়ার্ক (সিসিএন)। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্থপতি মোবশ্বের হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন টক শো উপস্থাপক জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান।
আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ, রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন, প্রথম সহ সভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বিজিএমইএ’র সভাপতি মো: শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন), রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো: নুরুল হুদা,সিনিয়র সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান, জাহিদুজ্জামান ফারুক, ব্যবসায়ী মনজুর আহমেদ, মেজর (অব) জিল্লুর রহমান, বিএনপির সাবেক এমপি নিলুফার চৌধুরী মনি, আওয়ামী লীগের এমপি নূর জাহান বেগম মুক্তা, ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেন, রি রোলিং মিলস এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু বকর প্রমুখ।
বিজিএমইএ’র সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আবাসন খাত এখন লাইফ সাপোর্টে আছে। প্লট বা ফ্ল্যাট ক্রয়ে রেজিষ্টেশন ফি এখন শতকরা ১৪ ভাগ। এটা পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। এটা কমিয়ে শতকরা ৭ ভাগে নামিয়ে আনতে হবে। ঢালাওভাবে সব ব্যবসায়ীদের ভ্যাট আইনের আওতায় নিলে সরকারের জন্য এটা বড় ধরনের ভুল হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, সোনার ডিম পাবার আশায় হাসকেই জবাই করার শামিল হবে ।
বিজিএমই সভাপতি আরো বলেন, ব্যবসা বাণিজ্যে আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। ২০০৮ সালের মন্দা থেকে এখনও বিশ্ব বেরিয়ে আসতে পারেনি। আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আবাসন খাতে গতি ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করতে হবে।
মুদ্রাপাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যসায়ীদের ঢালাওভাবে এর জন্য দায়ি করা হয়। এটি ঠিক নয়। আইন করে মুদ্রাপাচার ঠেকানো যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনি সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে পারেন কিন্তু মুদ্রা আটকিযে রাখতে পারবেন না। কাজেই এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে মুদ্রাপাচারই না হয়।
গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, আবাসন খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নেওয়া হলে সম্ভাবনাময় এই খাতটি মুখ থুবড়ে পড়বে । তিনি বলেন, কোন উন্নয়নশীল দেশে এতো ভ্যাট নেওয়া হয়না। ভ্যাট বা টেক্সের আওতা না বাড়িয়ে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা হতে পারে না। আবাসন খাতকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদে ও সিঙ্গেল ডিজিট হারে সুদের ব্যবস্থা করতে হবে।
মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, সকলের জন্য আবাসন ব্যবস্থার জন্য সরকার কাজ করছে, কেউ গৃহহীন থাকবে না। ৯৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ হাজার পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট তৈরি করা হচ্ছে। ঝিলমিল প্রকল্পে ১৩ হাজার অ্যাপার্টম্যান্ট, পূর্বাচলে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে।
বস্তিবাসীদের জন্য ভাড়াভিত্তিক আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে জানিয়ে মন্ত্রী আরো বলেন, সেখানে যারা থাকবে তাদেরকে দৈনিক হারে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। প্রতিটি ফ্লাটের আয়তন হবে ৫৫০ বর্গফুটের মতো। আলাদা টয়লেট, রান্নাঘর ও ওয়াশিং ব্যবস্থা থাকবে। প্রাথমিকভাবে ৫০০ অ্যাপার্টম্যান্ট করা হবে। তবে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ১০ হাজার অ্যাপার্টম্যান্ট তৈরি করা।
তিনি আরও বলেন, রাজউক, সিডিএসহ যেসব উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আগামীতে যেসব প্লট বরাদ্দ দিবে সেগুলো সবগুলো হাইরাইজ হবে, অ্যাপার্টম্যান্ট কমপ্লেক্স থাকবে। আমাদের শুধু শহরের দিকে নজর দলেই চলবে না, গ্রামেও পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকারও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
আলোচনায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, রাজউকের যে কাজ, তারা তা করছে না। তাদের নগর উন্নয়ন করার কথা কিন্তু তারা তা না করে নির্মাণ করছে। এনবিআরের কাজ নিয়েও প্রশ্ন করার সুযোগ আছে।
ব্যবসায়ীদের ভ্যাট আইনের বিরোধীতার সমালোচনা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কোন ব্যবসায়ী তো ভ্যাট দিবেন না। ভ্যাট দিবেন ভোক্তারা। যিনি পণ্য ক্রয় করবেন তিনি ভ্যাট দিবেন, আর যিনি করবেন না তিনি কোন ভ্যাটও দিবেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় যেমন- চাল, ডাল, তরিতরকারি, ওষুধকে ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এছাড়া যেসব ব্যবসায়ীর বার্ষিক টার্নওভার ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত তারাও ভ্যাটের বাইরে। শুধু অন্ধের মতো বিরোধিতা করলে চলবে না। ভ্যাটের কারণে যদি পেইনফুল পরিস্থিতি তৈরিও হয় আগামী দিনের জন্য এ পেইন সহ্য করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী।
রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, আমাদের নীতি হওয়া উচিত জনবান্ধব, ব্যবসা বান্ধব। কিন্তু তা হচ্ছে না। অন্যের যুক্তিতে ও পরামর্শে আইন করা হচ্ছে। ফলে সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায় না। রাজস্ব বাড়ানোর জন্যই যদি রাজস্ব নীতি করা হয় তাহলে রাজস্ব বাড়বে না।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খেজুর গাছ থেকে আমরা রস পাব। কিন্তু গাছটিকে যদি বাড়তে না দেই তাহলে রস পাওয়া তো দূরের কথা গাছটিই বাঁচবে না। সুতরাং নীতি বা আইন করার আগে বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা বলেন, পিপিপির আওতায় বাজেটে একটা বড় ধরনের বরাদ্দ থাকে। কিন্তু এক পয়সাও খরচ হয়না। এ বরাদ্দ আরও বাড়িয়ে আবাসন খাতে ব্যয় করে দারিদ্রসীমার নিচে যারা আছে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, গত ৭ বছর ধরে আবাসন খাতে ক্রান্তিকাল চলছে। এ খাতে অপ্রদর্শিত বা কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় তার সুফল মিলছে না। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদে ও স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার কারণে কিছুটা গতি ফিরেছে।
ভ্যাট ও করের হার না বাড়িয়ে বরং আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন।

 

http://www.dailysangram.com/post/282870-