৩ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৯:০০

৯ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ 

অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে বলে সতর্ক করেছেন  বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারের পার্বত্য এলাকাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া, কিশোরগঞ্জের হাওড় দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটি রেখা কল্পনা করা যায়, এলাকাটি হচ্ছে দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল। এ দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্বে অবস্থিত বার্মা প্লেট, পশ্চিমে অবস্থিত ইন্ডিয়ান প্লেট। এর সংযোগস্থলের উপরের ভাগটি অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মণিপুর, মিজোরাম পর্যন্ত অঞ্চলটি ‘লকড’ হয়ে আছে। অর্থাৎ এখানে শক্তি জমা হয়ে আছে। যেকোনো সময় এ শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।  

সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে একটি প্রতিবেদন করেছে। ভূমিকম্প বিশ্লেষকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেছে, রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা। ধসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের। 

চলতি বছরে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে দেশে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১২টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পে কেঁপেছে দেশ। এসব ভূমিকম্প হয়েছে সাড়ে নয় মাসের ব্যবধানে। ছোট ও মাঝারি মাত্রার এসব ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল দেশের ভেতর ও সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের দেশগুলোতে। ভূমিকম্পে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বারবার ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ ফল্ট লাইনগুলো সক্রিয় থাকায় এমন শঙ্কা করছেন তারা।

বছরের প্রথম ভূকম্পন অনুভূত হয় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের পাশাপাশি কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলা। ৩ দশমিক ৯ মাত্রার এ ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এর নয় দিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে মাঝারি মাত্রার জোড়া ভূমিকম্প আঘাত হানে। দেশটির আয়াবতি ও রাখাইন রাজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের কক্সবাজারেও ভূকম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার আগারগাঁও থেকে ৩৭৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। গত ৩০ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপে চট্টগ্রাম। ৫ মে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয় ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার সিটি সেন্টার থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে দোহারে। এক মাস পর গত ৫ জুন ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের কাছে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে। ১৬ জুন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ, মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫। ১৪ আগস্ট সিলেটে ফের ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। একইসঙ্গে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায়ও এটি অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল আসামের মেঘালয়, গভীরতা ছিল ৩৫ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ২২৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে।

২৯ আগস্ট সিলেট মহানগরীর আশপাশে ফের মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৫। উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তাপুরে। গত ৯ সেপ্টেম্বর সিলেট ও এর আশপাশের এলাকায় ৪.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসামে। ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে টাঙ্গাইলে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইল সদরে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ কিলোমিটার গভীরে ছিল এর অবস্থান। ২ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টা ৪৫ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর ছিল মাত্রা ৫.২। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয়ের রেসুবেলপাড়া নামক স্থান থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার (২ নভেম্বর) ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। আবহাওয়াবিদরা বলেন, নেপালে যেমন ইউরেশিয়ান প্লেট আর আমাদের ইন্ডিয়ান প্লেট (বাংলাদেশ যে প্লেটে অবস্থান করছে)। দুটি প্লেটের কনভারজেন্ট মুভমেন্ট বিদ্যমান। কনভারজেন্ট মুভমেন্ট হওয়ায় একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের দিকে মুভ করছে এবং একটি প্লেট  গ্রাজুয়ালি রাইজিং করছে। অর্থাৎ হিমালয়ের যে উচ্চতা, যেটি গত বছর যা ছিল তার চেয়ে একটু হলেও বেড়েছে। এজন্য যখন প্লেট মুভ করে এবং কোনো কারণে যদি ওখানে মুভমেন্ট কম হয় বা মুভমেন্ট না হয় তখনই সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। দেখা যায়, আমাদের প্লেট বাউন্ডারির লাইনগুলোতে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ হচ্ছে। অনেক বিজ্ঞানী বলেন, সংঘর্ষের ফলে যদি এনার্জি রিলিজ হয়, তাহলে ভালো। আর যদি এনার্জি রিলিজ না হয়, যদি সেখানে প্লেট বাউন্ডারি থাকে তাহলে এটি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, পরে যখন সেখান থেকে বড় ধরনের এনার্জি রিলিজ হয় তখন ভূমিকম্পের মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। আমাদের আশপাশে সক্রিয় তিনটি প্লেটের কারণে বলতে পারি যে, আমরা প্রবল ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে আছি, এটি নিশ্চিত।

আবহাওয়া বিজ্ঞানী আব্দুল মান্নান মনে করেন এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের প্রেডিকশন দেওয়ার মতো কোনো পদ্ধতি/প্রক্রিয়া আবিষ্কার হয়নি। যেহেতু এটি পৃথিবীর ইন্টারনাল বিহেভিয়ার এবং ইন্টারনালি লেট মুভমেন্ট এনার্জি রিলিজের মাধ্যমে এক প্লেট থেকে অন্য প্লেটে এনার্জি বিনিময় হয় বা কোনো কারণে যখন শক্তির পরিবর্তন হয়, তখনই ভূমিকম্পের মতো ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ কিন্তু ইউনিফর্মলি সৃষ্ট নয়। এখানে ননউনিফর্মিটি আছে এবং সে কারণেই পৃথিবীর সব জায়গা সমানভাবে গঠিত হয় না। যেমন- জাপানে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্প হয়। কিন্তু বাংলাদেশ বা এমন অনেক অঞ্চল আছে যেখানে সেভাবে ভূমিকম্প হয় না।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, বড় বড় ভূমিকম্প ভূপৃষ্ঠকে কোথাও উঁচু করে দেয়, আবার কোথাও নিচু করে দেয়। যেমন- চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল সৃষ্ট হয়েছে ভূমিকম্পের মাধ্যমে। দুটি প্লেটের পরস্পরমুখী সংঘর্ষ হলেই পাহাড়ের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া,  জনবসতিও স্থানান্তর করে ভূমিকম্প। বাংলাদেশের ইতিহাসে এগুলো আছে। অতীতে বাংলাদেশে বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে, এটি নিশ্চিত। যেমন- ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। ১৮৯৭ সালে গ্রেট ইন্ডিয়া ভূমিকম্পে এক হাজার ৬২৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া, ১৭৬২ সালের ভূমিকম্প হয়েছিল সাবডাকশন জোনে। 

এদিকে বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। 

https://www.dailysangram.info/post/542262