২ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:০৮

৩৮ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে

৩৮ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে

 

রাজধানীর মহাখালীর আমতলীতে গত ২৬ অক্টোবর বহুতল ভবন খাজা টাওয়ারে আগুন লেগে প্রাণ যায় তিনজনের, সম্পদহানি হয় বিপুল টাকার। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা প্রায় ১৬ ঘণ্টার চেষ্টায় ১৪ তলা ওই ভবনটির আগুন নেভান। তারা জানান, ভবনটিতে সার্বিকভাবে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান (অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা) ছিল না। শুধু এ ভবনটিই নয়, এর আগেও আগুনে পুড়েছে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বড় বড় স্থাপনা। যেসব ভবন বা মার্কেটে যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বলে অভিযোগ ওঠে।

চলতি বছরের ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন না হলেও, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের তথ্য বলছে, অধিদপ্তরের সদস্যরা সারা দেশে ৫ হাজার ৮৬৯টি সরকারি-বেসরকারি ভবন পরিদর্শন করেন। যার মধ্যে ২ হাজার ২২৩টি ভবনই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে প্রায় ৩৮ শতাংশ ভবন রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে।

গত ৪ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন লাগার পর নড়েচড়ে বসে কর্র্তৃপক্ষ। ঢাকার বিভিন্ন ভবন, মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ৫৮টি ভবন ও মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ২৩ হাজার ৫৩৩টি অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৪১ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

বিষেশজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগুনের ঘটনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তদন্ত এবং একে অন্যকে দোষারোপের মধ্য দিয়ে দায় সারতে চায়। ফায়ার সার্ভিসের কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তা বিস্তারিত জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়, কিন্তু কেউ কর্ণপাত করে না। বড় কোনো আগুনের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই ভবনের নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছে কি না, তা আর তদারকি হয় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও আইনের প্রয়োগের অভাবে অনেকেই অগ্নিনিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন। এমন পরিস্থিতিতে ভবন নির্মাণ ও দেখভালের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনের নিম্ন জলাধারের ধারণক্ষমতা, বাসিন্দার সংখ্যা, প্রবেশপথের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও অগ্নি-শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আকার, মই, লিফটসহ বেশ কিছু জরুরি জিনিসের ওপর ভিত্তি করে ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

২০২২ সালের প্রতিবেদন বলছে, সারা দেশে ওই বছর ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৯ হাজার ২৭৫টি ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগে। এর আগের বছর ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকা-ের মধ্যে ৭ হাজার ৯৫৫টি ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আগুনের সংখ্যা ২ হাজার ৫০১টি বেশি, যা অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে উদাসীনতাকে নির্দেশ করে।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাজ আগুন নেভানো, সমস্যা চিহ্নিত করা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে আরও সচেতন করা। আমরা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার পর মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করি। বাধ্য করা আমাদের কাজ নয়। আইন প্রয়োগ করার জন্য অন্যান্য সংস্থা রয়েছে।’

ছাড়পত্রবিহীন অবৈধ কারখানাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারখানা সরানো আমার কাজ নয়। তবে নিমতলী ও চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর ওইসব এলাকায় কোনো দোকান বা কারখানাকে আমরা ছাড়পত্র দিইনি। সেখানে যেসব দোকান বা কারখানা চলছে, তারা অবৈধভাবে চলছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘অগ্নিনিরাপত্তার দায়িত্ব প্রথমত যে ভবন মালিক তার। এসব ভবন যখন অগ্নিনিরাপত্তাসহ ভবনের অন্য কোনো বিষয় ফেইল করে তখন ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন সেখানে যায়। বিভিন্ন ছোট কারণে দুর্ঘটনা তো ঘটে, যা অনাকাক্সিক্ষত। তবে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের চিঠিপত্র যদি ফায়ার সার্ভিস দেয়, সে ক্ষেত্রে ওই ভবন সম্পর্কে আমাদের যে দায়িত্ব আছে আমরা সেটা পালন করি।’

গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার ও এর আশপাশের চারটি মার্কেটে আগুন লাগে। এতে বঙ্গবাজারের বেশিরভাগ দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ওই সময় ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেছিলেন, ২০১৯ সালে বঙ্গবাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে অন্তত ১০ বার ব্যবসায়ীদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। নোটিসও দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে মার্কেটের সামনে ব্যানার টানানো হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে। ব্যবসায়ীদের দাবি, ২২৬টি দোকানসহ প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যায়। এই মার্কেটটিও অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মার্কেটের মালিক সমিতিকেও এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কেউ তা আমলে নিয়ে তখন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এসব ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস রাজধানীর ৫৮টি মার্কেট ও শপিং মল পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ৯টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ১৪টিকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩৫টি মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেন, এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে নিরাপদ করতে ভবনের মালিক, দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতিকে যেসব পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তারা তা মানছেন না। ফলে মার্কেটগুলো নিরাপদ হচ্ছে না। এসব ঘটনায় তারা মার্কেট সমিতি বা কর্র্তৃপক্ষকে চিঠি দেন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। কিন্তু ওইসব মার্কেটে গিয়ে এখনো একই অবস্থা দেখা গেছে।

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব ও প্রধান প্রকৌশলী এবং রাজউকের চেয়ারম্যানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাদের সাড়া মেলেনি। অন্য কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হটকারী সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নে দায়বদ্ধতাহীনতায় ঢাকাসহ দেশের সব নগর চরম ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো আলাদা আলাদা মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া যারা ভবন তৈরি করছেন তাদের অবিবেচনাপ্রসূত ও লোভী কার্যক্রম এবং একই সঙ্গে এটা এনফোর্স করার (আইন প্রয়োগের) কর্র্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও হটকারিতা আমাদের আজকের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির কারণ।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি ক্রেতাদের চাপে পড়ে তৈরি পোশাক খাত তাদের কমপ্ল্যায়েন্স মেনে ঝুঁকি কমিয়েছে। এটা ভালো অভ্যাস ও উদারহণ। তারা সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে জনগণের এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনে আইনকানুন ও বিধিবিধান বাস্তবায়নের তাগিদ দেন। পাশাপাশি একে অন্যের ওপর অভিযোগ না করে সমন্বিতভাবে কাজ করলে আগুনের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। অন্যথায় সবাই ঝুঁকির মধ্যেই থেকে যাবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন মনিটরিংয়ের জন্য টাস্কফোর্স গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও জানান তারা।

একই ধরনের মন্তব্য করেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভবনের মালিকরা এমনিতেই উদাসীন। এর মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ, ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দেখা যায় শুধু পেপার ওয়ার্কে (কাগজে কলমে) সীমাবদ্ধ। তারা সরেজমিন খুব একটা যান না। অন্যদিকে মনিটরিং সিস্টেমটাও নেই। যে কারণে দেখা যায় ভবন মালিক বা মার্কেটের কর্র্তৃপক্ষ তারা নিয়ম মানায় উদাসীন।’

https://www.deshrupantor.com/471793