২ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:০৪

জিএসপি নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের মূল্যায়ন রিপোর্ট

ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ বাড়ছে

 

সাম্প্রতিক সময়ে একটার পর একটা বৈশ্বিক ইস্যু এসে পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। এরমধ্যে শ্রমিক
অধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঘোষিত নতুন নীতি (স্মারক)। অন্যটি হলো- জিএসপি নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের (ইইউ) মূল্যায়ন রিপোর্ট। উভয় রিপোর্টেই বাংলাদেশের মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এর ফলে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইইউতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি অব্যাহত রাখা হুমকির মুখে। 

 

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই দুই রিপোর্ট নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, তুরস্ক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, এমন দেশের ব্যাংকগুলোর লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হতে পারে। এ ধরনের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য বড় সতর্কবার্তা। অথচ ব্যবসায়ীদের উৎকণ্ঠার বিপরীতে বিষয়টিকে আমলেই নিচ্ছে না সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, শ্রম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

আর সরকারও কোনো চাপে নেই। 
তবে দু’টি ঘোষণায় চিন্তিত দেশের ব্যবসায়ী মহল। যু্‌ক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি ও জিএসপি নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের মূল্যায়ন রিপোর্ট পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন উদ্বেগ। এ ছাড়া আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে জড়িত ব্যবসায়ীরাও চিন্তিত। 

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বিধিনিষেধ ও ভিসা নীতির পর শ্রম অধিকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেয়া বক্তব্যটি এখন বড় শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা প্রবাহের পর ঘোষিত এ স্মারক এখন উদ্যোক্তাদের নতুন করে ভীতি তৈরি করেছে। 

জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার। এরমধ্যে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৪৮ শতাংশের গন্তব্য ইইউভুক্ত ২৭ দেশ। ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ৯৩ শতাংশই তৈরি পোশাক। জিএসপি’র কল্যাণে গত দুই দশকে এই বাজারে পোশাকশিল্প শক্ত জায়গায় পৌঁছেছে। অতএব দুই বাজারে বাণিজ্যে কোনোরকম বাধা সৃষ্টি হলে সার্বিক রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। 

সূত্র জানায়, দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ইইউতে পণ্য রপ্তানিতে সহায়তা করতে জিএসপি হচ্ছে ইইউ’র প্রধান বাণিজ্যনীতি। মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ, জলবায়ু ও সুশাসনের ওপর আন্তর্জাতিক মানকে সম্মান জানানোর শর্ত সাপেক্ষে জিএসপি সুবিধা দেয়া হয়। এ সুবিধার কারণেই বাংলাদেশের পণ্যের বড় রপ্তানি গন্তব্য হয়ে উঠেছে ইইউ। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৪৫ শতাংশ গেছে ইইউভুক্ত ২৭ দেশে। ইইউ বলেছে, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে ব্যর্থ হলে সুবিধাভোগী দেশগুলো তাদের জিএসপি সুবিধা হারাতে পারে।

জিএসপি নিয়ে ইইউ কমিশনের রিপোর্টে কী আছে
গত ২১শে নভেম্বর প্রকাশিত জিএসপি নিয়ে ইইউ’র মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইইউ। এতে ইইউতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি অব্যাহত রাখা হুমকির মুখে পড়েছে। 

ইউরোপীয় কমিশনের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি বিষয়ে মূল উদ্বেগগুলো হচ্ছে- ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন, ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং অবাধে ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম চালানোর অধিকারের আইনি বাধা; ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য ন্যূনতম সদস্যের প্রয়োজনীয়তা এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতি। মূল্যায়নে এসব বাধা দূর করার তাগিদ দেয়া হয়। পাশাপাশি কারখানা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার ঘাটতি সমাধানের কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে সহিংসতা, হয়রানি, বরখাস্ত, অপর্যাপ্ত তদন্ত, মামলা ও কর্মীদের গ্রেপ্তারের মতো ইউনিয়নবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া শ্রম পরিদর্শনে সক্ষমতা ও সামর্থ্যের ঘাটতি দূর করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। শিশু ও জোরপূর্বক শ্রমের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ইউরোপীয় কমিশনের এ প্রতিবেদনে।

এর আগে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারচর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ইইউ’র অবাধ বাজারসুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মসের’ (ইবিএ) পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান। 

২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল তালিকায় যুক্ত হলেও পরের তিন বছর সুবিধাটি থাকবে। তারপর ইইউতে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস পেতে হবে। যদিও বর্তমান নিয়মনীতিতে তা সম্ভব নয়। এ জন্য ইইউ’র সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দেনদরবার চলছে। 
জিএসপি প্লাস কেন দরকার

২০২৯ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবে ২০২৪-৩৪ সালের জন্য জিএসপি’র নতুন নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইউরোপীয় কমিশন। সেটি ইইউ পার্লামেন্টে এখনো অনুমোদন হয়নি।
এদিকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, স্মারকে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে, এর পেছনে রাজনীতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এর ব্যবহার করতে পারে। শ্রম অধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে মনে করলে  ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সুযোগ রয়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর পড়তে পারে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হয় চিঠিতে। 

এর আগে গেল ১৬ই নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি বা দিকনির্দেশনা ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্মারকে সই করেছেন। গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, মার্কিন ও ইইউ রিপোর্ট দুশ্চিন্তার। মনে রাখতে হবে, এটি বিচ্ছিন্নভাবে আসেনি। তারা আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বড় অংশীদার। তারা বড় বিনিয়োগকারী। ঋণসহায়তাও দেয়।
গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আগামী ১০ই ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো একটা বিবৃতি দেবে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তবে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে সরকারকে। কোথায় কী ধরনের দুর্বলতা আছে তা শনাক্ত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। 

রপ্তানিকারকরা বলেন, ইইউ পার্লামেন্টে জিএসপি সুবিধা চালু রাখা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটি অবশ্যই অস্বস্তিকর। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাবটি সরকারের গুরুত্ব নেয়া উচিত বলেও মনে করে এই রপ্তানিকারকরা।

বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের পাশাপাশি বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছি। আমরা মনে করি, ইইউ চাইবে না এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হোক। 

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে কিংবা বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে এ খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বেকার হবে শ্রমিক। বাংলাদেশ শ্রমিকদের অনুকূলে গত ১০ বছরে ৩ বার শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও করা হবে। 

রংপুরে মন্ত্রীর নিজ বাসভবনে উদ্যোক্তাদের উদ্বেগের বিপরীতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আমেরিকা-ইউরোপ মিলে পোশাক রপ্তানি বন্ধে যে পাঁয়তারা করছে, তা বাস্তবায়ন হবে না। বলেন, রাজনীতি ও ব্যবসা আলাদা জিনিস। ইউরোপ-আমেরিকা এমন কিছু করবে না, যার প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পড়তে পারে। 

বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি আসলাম সানি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই নীতি শুধু আমাদের জন্য নয় সারা বিশ্বের জন্য। তবে নীতি যদি বাংলাদেশের ওপর কার্যকর হয় তখন সেটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। 

বিজিএমইএ’র পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এই নীতি কোনো ব্র্যান্ডের ওপর বা বাংলাদেশকে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। ফলে চিন্তার কোনো কারণ নেই। যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে যাই তাহলে চিন্তার বিষয়। 

প্রসঙ্গত, ইইউ বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার। তবে আর যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে একক প্রধান বাজার। তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশই আসে সমজাতীয় পণ্যসহ পোশাক খাত থেকে। মোট পোশাক রপ্তানির ২০ থেকে ২২ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩২ শ্রমিক নিহত হন। দুর্ঘটনার পর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিবেশ না থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। 
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যের মোট রপ্তানির মধ্যে ৯৩ শতাংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক। গত অর্থবছর দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি। তৈরি পোশাক ছাড়াও এই বাজারে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, বাইসাইকেল ইত্যাদি জিএসপি সুবিধার আওতায় পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি হয়।

https://mzamin.com/news.php?news=86274